একটা কৌতুক বানালাম। দুই বন্ধুর দেখা। প্রথমজন জিজ্ঞেস করল:
‘শোন, দোস্ত, আমি মরে গেলে তুই অন্তত পাঁচ রুবল খরচ করে ফুল কিনে আমার কফিনের ওপরে দিতি না?’
‘নিশ্চয়ই দিতাম,’ বলল দ্বিতীয়জন। ‘আমি তোকে ভালোবাসি না!’
‘তাহলে শোন, সেই পাঁচ রুবল তুই এখন আমাকে দে; আর আমি যখন মরব, তখন তোকে ফুল কিনতে হবে না।’
অফিসে কলিগদের কৌতুকটা বললাম। সবাই হাসল খুব। আর পাচিভালভ বলল, ‘তুমি এক কাজ করো। কৌতুকটা লিখে পত্রিকা অফিসে নিয়ে যাও। বিখ্যাত হয়ে পড়বে দেশজুড়ে।’
তার কথা শুনে গেলাম পত্রিকা অফিসে। ‘হিউমার’ বিভাগের সম্পাদক আমার কৌতুক পড়ে বললেন, ‘হুম্! খুব জমেনি মোটেও। কী এটা? এর ধরনটা কী?’
‘কৌতুক। বলতে পারেন, বিদেশি কৌতুকের ধাঁচে।’
‘ধাঁচে…না, চলবে না। বড়ই দুর্বল। মজাদার নয়। দুঃখিত।’
মন খারাপ হলো কথাটা শুনে। কিন্তু কী আর করা!
এক সপ্তাহ পরের কথা। পাচিভালভ আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘পত্রিকা অফিসে গিয়েছিলে?’
‘গিয়েছিলাম।’
‘কী খবর?’
আমি সব তাকে খুলে বললাম। মিনিট দুয়েক চুপ করে থাকল পাচিভালভ। কী যেন ভাবল। তারপর হো হো করে হেসে উঠে বলল, ‘তুমি এক কাজ করো…’
আবার গেলাম সেই পত্রিকা অফিসে। বিভাগীয় সম্পাদক আমাকে চিনতে পারলেন না। তাঁর টেবিলের ওপরে রাখলাম কৌতুকটি। পড়ে তিনি গলা ফাটিয়ে হাসতে শুরু করলেন। তারপর কাশতে কাশতে বললেন, ‘দারুণ! আহ্, কী দারুণ! স্রেফ অদ্ভুত!’
এক মাস পর বেরোল পত্রিকার নতুন সংখ্যা। শেষ পৃষ্ঠায় কৌতুকটি প্রকাশিত হলো এভাবে:
বিদেশি কৌতুক
পান* মালিনোভস্কি , ‘আমি মরে গেলে অন্তত পাঁচ জেলাতি খরচ করে ফুল কিনে আমার কফিনের ওপর দিতেন না?’
‘নিশ্চয়ই দিতাম।’ বললেন পান কুরকা। ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি না!’
‘তাহলে শুনুন, সুপ্রিয় পান মালিনোভস্কি, সেই পাঁচ জেলাতি আপনি এখন আমাকে দিন; আর আমি যখন মরব, তখন আপনাকে ফুল কিনতে হবে না।’
নিজের এই সাহিত্যকীর্তির কথা আমি প্রায় ভুলে যেতেই বসেছিলাম। তখন একদিন আমার বাড়িতে এল পাচিভালভ। বলল, ‘দেখো, এখানে কী ছাপা হয়েছে।’ বলে আমার হাতে ধরিয়ে দিল সংগীতচিত্র নামের একটা পত্রিকা। আমি পড়তে শুরু করলাম—
একদিন মোৎসার্ট জিজ্ঞেস করলেন সালিয়েরিকে:
‘শোনো, সালিয়েরি, আমি মরে গেলে…’
এরপর আমার পুরো কৌতুকটা।
পড়ে কেমন যেন লাগল আমার। একদিক থেকে ভেবে দেখলে ব্যাপারটা প্রীতিকর—মনীষীদের মুখে আমার বানানো সংলাপ। আবার অন্যদিক দিয়ে ভেবে দেখলে অস্বস্তি হয়—তাঁদের নিজস্ব কথা কি নেই?
এরপর শুরু হলো…
সাহিত্য সমীক্ষা পত্রিকায় ছাপা হলো, বার্নার্ড শ জিজ্ঞেস করলেন হার্বার্ট ওয়েলসকে:
‘শুনুন, মিস্টার ওয়েলস…’
ছোটদের বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত হলো, বিজ্ঞানী-প্রকৃতিবিদ হামবোল্ড প্রশ্ন করলেন লবাচেভস্কিকে…
শস্য পত্রিকায় মিচুরিন জিজ্ঞেস করলেন…
অপেরা ও অপেরেট পত্রিকায় শালিয়াপিন প্রশ্ন করলেন…
পিতা আলেক্সান্দর দুমা প্রশ্ন করলেন পুত্র আলেক্সান্দর দুমাকে…
রাতে ঘুমিয়ে আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে পাচিভালভ পর্যন্ত যাবতীয় খ্যাতিমান মনীষীদের।
প্রতিদিন সকালে পত্রিকার দোকানে যাই, নতুন পত্রিকা কিনি, আর তাতে খুঁজে পাই প্রতিভাধরদের মুখে আমার বানানো যাচ্ছেতাই সেই কৌতুকের সংলাপ। আমার এখন কী কর্তব্য, বুঝতে পারি না। মনীষীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা তো সম্ভব নয়। তাঁরা সবাই মৃত। তাঁদের মুখে যেকোনো সংলাপই জুড়ে দেওয়া যায়। আর জীবিতদের কেউ বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না যে কৌতুকটির রচয়িতা আমি।
* পোলিশ ভাষায় ‘জনাব’।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৬, ২০১১
Leave a Reply