‘পারবি তো?’ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন বস।
‘আবার জিগায়! পারব না মানে?’
‘যা তাইলে।’
আমি রওনা দিলাম। গায়ে দৌড়-ঝাঁপের জন্য সুবিধাজনক পাতলা পোশাক, চোখে নাইট ভিশন গগলস, হাতে গ্লাভস। কবজির ব্যান্ডটা ১০ ফিটের মধ্যে কোনো প্রাণী এলেই সিগনাল দেবে।
আমি আর আমার বস বড় বড় ফলের বাগান থেকে ফল চুরি করে চোরাই মার্কেটে বিক্রি করি।
আগের অপারেশনে বসের মাথায় একটা কাঁঠাল পড়ায় (উফ্! একটা দৃশ্য ছিল বটে!) তিনি আপাতত বিছানাবাসী। আজকের ‘অপারেশন লিচু’ আমাকে একাই সারতে হবে।
বাবুদের বাগানের দেয়ালের কাছে এসে পকেট থেকে আলট্রা রিমোট বের করলাম। বোতাম টিপতেই বাগানে সেট করা সিসি ক্যামেরাগুলো আগের ভিডিও দেখাতে থাকবে। দেয়ালের কাছে দুজন গার্ড আর সিসি স্ক্রিন দেখার জন্য দুজন টেকনিশিয়ান। ঘুমের ওষুধ ভরা ডার্ট ছুড়ে তাদের ঘায়েল করা গেল। ঝোপের মধ্যে লুকানো অ্যালার্মের মেইন তার কাটলাম।
দেয়ালের কাছে এসে গ্লাভসের বোতাম টিপলাম। মাথায় হুক লাগানো তার বের হলো। দেয়ালের মাথায় হুক আটকে জুতা বদলে নিলাম। সাকশান জুতা এখন আমার পায়ে। খাড়া জায়গা বেয়ে ওপরে ওঠা এখন কোনো বিষয় না। তার ধরে উঠতে লাগলাম।
এই সেরেছে! নতুন জুতা। বেশি জোরে দেয়ালে পা ফেলায় সাকশান কাপ মারাত্মক শক্ত হয়ে লেগেছে। দুই পা-ই আটকে গেছে আমার। পা টানাটানি করতে করতে হাঁটু ব্যথা হয়ে গেল, খোলে না। কী মুশকিল! শক্ত করে তার ধরে ডান পা তোলার জন্য হ্যাঁচকা টান দিলাম। এবার খুলল—জুতা না হুক। দেয়ালে পা রেখে চিত হয়ে গেলাম আমি এবার।
অনেক কষ্টে জুতা খুলে ফেললাম অবশেষে। খসে পড়লাম দেয়াল থেকে। এই জঘন্য জুতা আর পরা যাবে না। পকেট থেকে মিনি পিসিটা বের করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম, ‘সাকশান জুতার গুষ্টি কিলাই!’ তারপর জুতা ছাড়াই শুধু তার ধরে হাচড়ে-পাচড়ে কোনো রকমে উঠে পড়লাম দেয়ালে, লাফিয়ে বাগানে নামলাম। ওফ্, হাত-পা ছিলে গেছে। বদমাশ জুতা!
আস্তে আস্তে একটা গাছের দিকে এগিয়ে গেলাম। আশপাশে কোনো প্রাণী আছে কি না জানার জন্য কবজির ব্যান্ডটা সুপার সার্চ মুডে দিলাম। চারদিক থেকে হাজার হাজার সিগনাল আসা শুরু করল। ওফ্, বাগানভর্তি পোকামাকড় ছাড়া কিছু নেই। সুনসান নীরব।
লিচুতে ভর্তি একটা গাছের কাছে এসে দাঁড়ালাম। সাকশান জুতা নেই। তাই একটা হুক লাগিয়ে দিলাম গাছের ডালে। তার ধরে গাছ বাইতে শুরু করলাম।
এক ডালে উঠেই হাঁপিয়ে গেছি। উফ্, কোমর গেল রে বাবা। এত নিচে কোনো লিচু নেই। আরও ওপরে উঠতে হবে। আরে, ওই তো একটা ছোট ডাল। একদম সিড়ির মতো ওপরে উঠে গেছে। খুশি হয়ে ওটার ওপর পা দিলাম। ও বাবা, এ দেখি ভাঙা ডাল। মড়াৎ করে ডাল আলাদা হয়ে গেল। আমি নিচে এসে পড়লাম সোজা…কিসের ওপর? প্রথমে বুঝিনি। চোখের সামনে বেশ সরিষা ফুলের সভা দেখছিলাম। কিন্তু পিঠে এক মণি একটা কিল খেয়ে সরিষা পালাল। বিরাট এক রোবট, আমি ঠিক এর ঘাড়ে পড়েছি। বাবুরা তাদের বাগানে রোবট মালী রাখে গোপনে, এটা জানতাম না।
‘আমাদের ভাঙা ডালে ফাঁদ ছিল। মড়াৎ শব্দে আমি চালু হই। আমাদের ভাঙা ডালে ফাঁদ ছিল। মড়াৎ শব্দে আমি চালু হই…’ আমার পিঠে মারতে মারতে একঘেয়ে গলায় বলতে লাগল সে।
রোবটের সঙ্গে মারামারি করা চাট্টিখানি কথা না। একটু ফাঁক পেয়েই সোজা দৌড় দিলাম আমি। দেয়ালের কাছে এসে মাথায় হাত। হুক ফেলে এসেছি। রোবট মালীর গলা পেছনে।
‘আমাদের ভাঙা ডালে ফাঁদ ছিল। মড়াৎ শব্দে আমি চালু হই…’ বলতে বলতে আমাকে দুই হাতে ধরে ছুড়ে মারল, একবারে দেয়ালের বাইরে।
হাড়গোড় সব আলাদা হয়ে গেল বোধ হয়। সারা জীবনে আর উঠে দাঁড়াতে পারব কি না ভাবছি, এমন সময় কানের কাছে ঘেউ ঘেউ । রোবট বেটা কি বাইরে এসে ঘেউ ঘেউ করছে নাকি? ‘আমাদের ভাঙা ডালে ফাঁদ ছিল। মড়াৎ শব্দে আমি চালু হই..’ এটা ঘেউ ঘেউয়ের চেয়ে ভালো ছিল। চোখ মেললাম। মনে হলো আজকে আমি শেষ। এখানেই। পাশের বাড়ির হাবুদের ব্লাডহাইন্ড কুকুর। এক লাফে উঠে দাঁড়ালাম। (ইয়েস, দাঁড়াতে পারছি), তারপর দৌড় আর দৌড়! পেছনে মস্ত জিভ বের করে আসছে ব্লাডহাউন্ড। আরও জোরে দৌড়ালাম আমি। হায়রে লিচু! হায়রে চুরি! হায়রে জুতা! হায়রে রোবট! শেষ পর্যন্ত কুকুরের তাড়া। ছি ছি। সবাই জানলে জীবনে আর ফেসবুকে ফেস দেখাতে পারব না।
পাশের এক বাসার দেয়ালে এক ফোকর দেখে ডাইভ দিয়ে ঢুকলাম। কুকুরটা বাইরে ঘেউ ঘেউ করছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর কুকুরটা বিদায় নিল। উফ্, লিচু চুরিতে আমি আর নাই। তওবা, তওবা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ৩০, ২০১১
Leave a Reply