রবীন্দ্রনাথ এ চিঠিঠি লিখেছিলেন অধ্যাপক সুধা সেনের (১৯১২—১৯৮৩) একটি চিঠি উত্তরে। এ নিয়ে সুধা সেনের একটি অপ্রকাশিত লেখা ছাপা হলো। চিঠিতে ভুলবশত ২৯/৩/২৯ লেখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চিঠিটি ১৯৩৯ সালে লেখা। লেখাটি আমাদের দিয়েছেন সুধা সেনের কন্যা সুনন্দা কবীর।
তখন ব্রিটিশ আমল ও অখণ্ডিত দেশ। আসা-যাওয়া করতে পাসপোর্ট, ভিসা লাগত না। কাজেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতা মাঝেমধ্যেই পূর্ববঙ্গে আসতেন। তাঁদের সমুজ্জ্বল সংস্কৃতির আলোয় পূর্ববঙ্গ ঝলমল করে উঠত। অবশ্যই পূর্ববঙ্গ কেবল গ্রহণই করত না—শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, সংগীতে তারও অবদান কম ছিল না। বিশেষত কুমিল্লা তখন শিক্ষা-সংগীত জগতে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে ছিল। সুরের গুরু আলাউদ্দীন খান, ওস্তাদ খসরু মিঞা, শচীনদেব বর্মণ (যদিও তিনি ত্রিপুরার, কিন্তু কুমিল্লা তখন ত্রিপুরার অন্তর্গত ছিল এবং শচীনদেবের সংগীতচর্চার প্রধান কেন্দ্রই ছিল কুমিল্লা), সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য, সুবোধ পুরকায়স্থ কুমিল্লারই কৃতী সন্তান। তখন দুই বাংলা এক অচ্ছেদ্য সাংস্কৃতিক বন্ধনে সংযুক্ত ছিল।
বাংলা ১৩৪৫ সনে (খ্রি. ১৯৩৯) কুমিল্লার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে সাহিত্য পরিষদ কুমিল্লা শাখার এক সম্মেলনের আয়োজন হয়। সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প, সংগীত শাখার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাতে আমন্ত্রিত হয়েছেন এবং তাঁরা এই অধিবেশনে যোগদান করবেন বলে সম্মতিও জানিয়েছেন। স্থান, তারিখ সমস্তই ঠিক হয়েছে, ঠিক হয়নি শুধু উদ্বোধন সংগীত! ‘বন্দেমাতরম্’ গাওয়া চলবে না। তবে? ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা?’ না, তাও ঠিক উপযুক্ত হবে না।
আমার স্বামী অধ্যাপক সুধীর সেন দীর্ঘকাল শান্তিনিকেতনে ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের প্রিয় শিষ্য। তিনি এবং রবীন্দ্রসংগীতানুরাগী আরও কয়েকজন অধ্যাপক প্রস্তাব করলেন, ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা’ গানটি গাওয়া হোক উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে। তখন ব্রিটিশ শাসনের কঠিন লৌহশৃঙ্খলের বাঁধন শিথিল হয়ে এসেছে। বন্ধনমুক্তির প্রয়াসে আলোড়িত হচ্ছে জনমানস, বিদ্রোহ জেগেছে প্রাণে প্রাণে। তাই কুমিল্লার বিশিষ্ট নেতারা প্রবল আপত্তি তুললেন, ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জের দিল্লি অভিষেক উপলক্ষে তাঁর স্তুতি করে যে গান কবি লিখেছিলেন, সে গান কিছুতেই এই অধিবেশনে গাওয়া চলবে না। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠল সভা—অধ্যাপকদের ক্ষীণকণ্ঠ সে প্রতিবাদের জোয়ারে কোথায় গেল তলিয়ে। ক্ষুণ্ন ক্ষুব্ধ মনে রবীন্দ্র অনুরাগীরা সভা থেকে সরে এলেন।
অধ্যাপক সেন যখন কবির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ছিলেন, তখনও আমার বিবাহ হয়নি—কাজেই কবির সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল না। আমি তখন বধূমাত্র। রবীন্দ্র-ভক্তদের পরাভব দেখে হয়তো বা আমি স্বামীকে না জানিয়েই স্বয়ং কবির কাছে একটি ছিঠি লিখলাম। বয়সোচিত চপলতায় ‘জনগণমন’ গানটি সম্বন্ধে এখানকার সমালোচনার কথা জানিয়ে এই গান কী উপলক্ষে তিনি রচনা করেছিলেন, তা তাঁর কাছে জানতে চাইলাম।
এ প্রসঙ্গে আমার চিঠিটির একটি অংশের উদ্ধৃতি নিচে দেওয়া গেল:
‘যাক একটা প্রশ্ন করি—প্রশ্নটা ঠিক আমার নয়—তবে কথাটা যখন উঠিয়াছে তখন স্বয়ং কবির মুখ হইতেই জবাব শোনা ভালো।
‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটির ‘অধিনায়ক’ ও ‘ভারত ভাগ্যবিধাতা’ হিসেবে কি আপনি কোনও ব্যক্তিকে বুঝাইতেছেন? সম্রাট পঞ্চম জর্জ বা অপর কোনও রাজার উদ্দেশ্যে কি ইহা লেখা হইয়াছিল?
এই প্রশ্নগুলির জবাব যদি আপনি খুব তাড়াতাড়ি দেন, তবে বড় ভালো হয়।
আমার বুদ্ধি অত্যন্ত কম, তাই এই গানটি কোনও ব্যক্তির জয়গান নয় বলিয়াই আমার ধারণা! অথচ এই ধারণাটির জন্য প্রবীণ কয়েকজনের কাছে সেদিন হাস্যাস্পদ হইলাম, তাই আপনাকেই লিখিলাম জবাব পাইলে একবার শুধু জবাবটুকু ওঁদের বলিব! তা ছাড়া জবাব পাইলে আমাদের একটি উদ্দেশ্যও সাধিত হয়।’
কয়েক দিনের মধ্যেই রেজিস্ট্রি করা চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার রসিদটি ফিরে এল এবং পড়বি তো পড়, স্বামীর হাতেই। বিশ্বভারতীর ছাপ দেওয়া কবির সেক্রেটারির স্বাক্ষরিত রসিদ। বিস্মিত সেন মশাই ছুটে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী এর অর্থ? তখন আর স্বীকারোক্তি করা ছাড়া উপায় ছিল না, বললাম গোপন চিঠির কথা। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে স্বামী আমাকে রীতিমতো ভর্ৎসনা করলেন—এই ছেলেমানুষী করার কী প্রয়োজন ছিল? বিশ্বকবির মহামূল্যবান সময়ের ক্ষতি করা, সর্বোপরি এসব ক্ষুদ্র ব্যাপার নিয়ে তাঁর মতো মহামানবকে বিরক্ত করার মতো নির্বুদ্ধিতা আমার কেমন করে হলো? না জানি কী অপরাধ করেছি ভেবে ভীত, লজ্জিত আমি চুপ করে রইলাম।
তারপর এক উজ্জ্বল প্রভাতে, আমার কম্পিত হাতে এল চিঠি, তাতে বিশ্বভারতীর ছাপ! চিঠি খুললাম। অপরূপ সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা স্বয়ং কবির চিঠি!
শান্তিনিকেতন
ওঁ
‘কল্যাণীয়াসু’
তুমি যে প্রশ্ন করেছ এ রকম অদ্ভুত প্রশ্ন পূর্বেও
শুনেছি।
পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা
যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী
হে চির সারথী, তব রথচক্রে
মুখরিত পথ দিন রাত্রি—
শাশ্বত মানব ইতিহাসের যুগযুগ ধাবিত
পথিকদের রথযাত্রায় বলে আমি চতুর্থ জর্জের
স্তব করতে পারি এ রকম অপরিমিত মূঢ়তা
আমার সম্বন্ধে যাঁরা সন্দেহ করতে পারেন,
তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আত্মবমাননা।
ইতি ২৯/৩/২৯ [’৩৯]
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই মহামূল্যবান চিঠি পেয়ে উল্লাসে আনন্দে অধ্যাপক সেন অধীর হয়ে উঠলেন। আর তখন? মুহূর্তে দূর হয়ে গেল সকল সংশয় আর ভয়। আমার নাগাল আর পায় কে! সাহিত্য পরিষদের মিথ্যা বাগাড়ম্বর স্তব্ধ হয়ে গেল—সর্বসম্মতিক্রমে এ গানই উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে নির্বাচিত হলো।
১৩৪৫ সনের ২২ চৈত্র থেকে ২৬ চৈত্র পর্যন্ত পাঁচ দিন বিভিন্ন শাখার অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। মূল সভাপতি ছিলেন ভাষাতত্ত্ববিদ ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সহসভাপতি কাজী আবদুল ওদুদ, বিজ্ঞান শাখার সভাপতি ড. পঞ্চানন নিয়োগী, ইতিহাস—ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন, দর্শন—পণ্ডিত বিধূশেখর শাস্ত্রী। তা ছাড়া সাহিত্য শাখার অধিবেশনে যোগদান করেছিলেন প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আরও অনেকে। সংগীতে ছিলেন কবির ভাগিনেয়ী সরলা দেবী।
কুমিল্লার বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সংগীতশিল্পী প্রভৃতিও এসব অধিবেশনে তাঁদের মূল্যবান বক্তব্য রেখেছিলেন। এত সব গুণী জ্ঞানী বিদগ্ধ ব্যক্তির সমাবেশে সভার উদ্বোধনে যখন ‘জনগণমন’ গানটি সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হলো, তখন পুলকে আনন্দে গর্বে আমি উদ্ভাসিত হয়ে উঠলাম।
কিন্তু তারও যে পর আছে, আছে আরও গৌরব, সে কথা তখন আমাদের জানা ছিল না। ১৯৪৭ সাল, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দ্বিখণ্ডিত দুই দেশ। জাতীয় সংগীত নিয়ে ভারতবর্ষে বিরাট মতদ্বৈধ দেখা দিল। সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি, একই প্রশ্নের সমাধানবিহীন উচ্চারণ। আরম্ভ হলো তুমুল আন্দোলন—যে গান সম্রাট পঞ্চম জর্জের অভিষেক উপলক্ষে রচিত, সেই গান স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে কিছুতেই গৃহীত হতে পারে না। প্রবল প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলেন বিশিষ্ট নেতারা। আনন্দবাজার, যুগান্তর প্রভৃতি কাগজে আরম্ভ হলো প্রবল বাগিবতণ্ডা।
সে সময়ে কবি আর জীবিত নেই। এই বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য কেউ কেউ আমার কাছে কবির স্বহস্তে লিখিত চিঠিটির একটি প্রতিলিপি চেয়ে পাঠালেন। যথাশিগগির সম্ভব প্রতিলিপি পাঠিয়ে দিলাম।
আমার এই চিঠি এবং দিল্লির এক ভদ্রলোকের কাছে কবির লেখা প্রায় একই ধরনের আরেকটি চিঠির প্রতিলিপিও যখন ভারতীয় নেতাদের হাতে পৌঁছাল, তখন প্রতিবাদমুখর ব্যক্তিরা নম্রনীরবতায় মেনে নিলেন স্বয়ং কবির স্বহস্ত লিখিত বাণী। দেশের জনগণ তখন ‘যুগযুগধাবিত’ রথের চিরসারথীকে বরণ করে নিলেন সানন্দে! ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে, ভারত ভাগ্যবিধাতা’ গানটিই ভারতের জাতীয় সংগীতরূপে স্বীকৃতি পেল।
আমার মতো অতি সাধারণ এক গৃহবধূর নির্বুদ্ধিতার ফলস্বরূপ এই দুর্লভ চিঠিখানিই যে এত বড় ঐতিহ্য ও গৌরবের অধিকারী হবে একদিন, তখন তো তা জানতাম না!
স্বামীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম বিজয়িনীবেশে, যেন আমিই জনগণমনের অধিনায়িকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৭, ২০১০
Leave a Reply