এখানে থাকে অহংকার, আর রাস্তার ওপাশে মূর্খতা। সহূদয় দুই প্রতিবেশিনী, চরিত্রের মিল নেই যদিও। মূর্খতা হাসিখুশি ও বাচাল, আর অহংকার বেজায় বিষণ্ন ও স্বল্পবাক। তবে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলে দুজনই।
একদিন অহংকারের কাছে এল মূর্খতা; বলল, ‘জানো, প্রতিবেশিনী, একটা খুশির খবর আছে আমার। গোয়ালঘরের ছাদের ফুটো দিয়ে পানি পড়ত কত বছর ধরে, আমার পালিত জন্তুগুলো রোগে ভুগত…। গতকাল হয়েছে কি, ছাদ ভেঙে পড়েছে, জন্তুগুলো চাপা পড়ে মারা গেছে। একবারে দুটো বাজে ব্যাপার থেকে মুক্তি পেলাম!’
‘হুঁ,’ সম্মতি জানিয়ে বলল অহংকার। ‘এমন ঘটনাও ঘটে…’
মূর্খতা বলল, ‘জানো, আমার খুব ইচ্ছে করছে এই ঘটনা উদ্যাপন করতে। লোকজনকে আমন্ত্রণ জানাব কি না ভাবছি। তবে কাকে কাকে ডাকব, বলো তো?’
‘এত বাছাবাছির কী আছে!’ অহংকার বলল। ‘সবাইকে ডাকো। নইলে লোকজন ভেবে বসবে, তুমি দরিদ্র।’
‘সবাইকে? একটু বেশি হয়ে যাবে না?’ দ্বিধান্বিত স্বরে মূর্খতা বলল। ‘সবাইকে খাওয়াতে গেলে তো আমাকে সব বেচে দিতে হবে। ঘরের জিনিসপত্রসহ।’
‘তাতে কী!’ মৃদু ভর্ৎসনা করল অহংকার। ‘দেখুক সবাই!’
সব বেচেবুচে দিল মূর্খতা, নিমন্ত্রণ জানাল অতিথিদের। প্রচুর পান-ভোজন হলো, হই-হুল্লোড় হলো প্রাণ খুলে। অতিথিরা যখন চলে গেল, মূর্খতা একা বসে রইল নিজের শূন্য বাড়িতে।
এদিকে অহংকারও রাগ করে বসে আছে। বলছে, ‘কেন যে গায়ে পড়ে উপদেশ দিতে গিয়েছিলাম! আমার এখন দুঃসময়। তোমাকে নিয়েই সবাই কথা বলে এখন। আমার দিকে তাকিয়েও দেখে না। বুঝতে পারছি না, কী করা উচিত। কোনো উপদেশ দিতে পারো?’
‘এক কাজ করো। নিজের বাসায় আগুন লাগিয়ে দাও। সবাই ছুটে আসবে দেখতে।’
তা-ই করল অহংকার। আগুন লাগিয়ে দিল নিজের বাড়িতে। লোকজন জড়ো হয়ে আঙুল উঁচিয়ে অহংকারকে দেখাচ্ছিল।
তৃপ্ত অহংকারের নাক এতটাই উঁচু হলো যে দমকল বাহিনীর পাইপ দিয়েও অত ওপরে ওঠা সম্ভব ছিল না।
তবে তৃপ্তির কাল কেটে যেতে সময় লাগল না। বাড়ি পুড়ে ছারখার, লোকজন যে যার বাসায় ফিরে গেল আর অহংকার দাঁড়িয়ে রইল রাস্তার মধ্যিখানে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আর কোনো উপায় না দেখে সে গেল মূর্খতার কাছে।
‘আমাকে গ্রহণ করো, প্রতিবেশিনী। আমার তো থাকার কোনো জায়গা নেই,’ বলল সে।
‘এসো, এসো,’ মূর্খতা বলল। ‘আমার এখানেই থাকো। তবে তোমাকে কিছু দিয়ে আপ্যায়ন করব, সে উপায় তো নেই! পুরো বাড়ি ফাঁকা। কিছুই নেই।’
‘অসুবিধে নেই, হলোই না হয় ফাঁকা!’ অহংকার বলল। ‘তবে অন্য কাউকে তা বুঝতে দিয়ো না।’
সেই থেকে তারা দুজন থাকে একসঙ্গে। একজনকে ছাড়া অন্যজনের এক মুহূর্তও চলে না। যেখানে মূর্খতা, সেখানে অবধারিতভাবে অহংকার, আর যেখানে অহংকার, সেখানে অবধারিতভাবে মূর্খতা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২৫, ২০১১
Leave a Reply