বেশ ছিলাম। আপিসে সাহেব এবং গৃহে মা-ষষ্ঠী আমার প্রতি সদয় ছিলেন। সাহেব আমার মাহিনা এবং মা-ষষ্ঠী আমার সংসার বাড়াইতেছিলেন। আমার পিতৃমাতৃকুলে আর কেহ ছিল না। উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু টাকাও জুটিয়া গিয়াছিল। খাসা ছিলাম।
প্রভাবতী অর্থাৎ আমার গৃহিণী গড়ে বছরে দেড়টি করিয়া সন্তান প্রসব করিয়া চারি বৎসরেই আমাকে ছয়টি পুত্রকন্যার মালিক করিয়া তুলিয়াছিলেন—মাঝে দুইবার যমজ হয়।
এবংবিধ প্রজাবৃদ্ধি সত্ত্বেও কোনো অভাব ছিল না। হঠাৎ কিন্তু বেকুব বনিয়া গেলাম। পঞ্চম বর্ষেও গৃহিণী তাঁহার স্বাভাবিক গর্ভভার বহন করিতেছিলেন। এবার কিন্তু ব্যাপারটা স্বাভাবিক হইলেও সহজ ছিল না, বোঝা গেল। কারণ, তিনি মারাই গেলেন। তিনি তাঁহার পিত্রালয় শান্তিপুরে ছিলেন। যদিও আমার শ্বশুর ও শাশুড়ি উভয়েই অনেককাল স্বর্গীয় হইয়াছেন। কিন্তু আমার শ্যালক বিনোদ ডাক্তার বলিয়া প্রভা প্রতিবারই সেখানে যাইত। বিনোদ লিখিতেছে:
‘হঠাৎ একম্পসিয়া হইয়া দিদি তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে মারা গেলেন। আপনাকে খবর দেওয়ার সময় ছিল না। কিডনি খারাপ ছিল। সেজদি ছেলেদের লইয়া সম্বলপুরে চলিয়া গিয়েছেন। তাঁহার চিঠি বোধহয় পাইয়াছেন।’
পাইলাম তো। তিনি লিখিতেছেন: ‘কী করিবে বল ভাই! সবই অদৃষ্ট। তোমার ছেলেমেয়েরা এখন আমার কাছে কিছুদিন থাকুক। আমি তো বাঁঝা মানুষ। আমার কোনো অসুবিধা হইবে না। ছেলেরা ভালোই আছে। কোনো ভাবনা করিয়ো না। ইতি…’
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া ছুটির দরখাস্ত করিলাম। কপালগুণে আমার সাহেবও বদলি হইয়া গিয়াছিলেন। ছুটি সুতরাং মঞ্জুর হইল না। দুই মাস পরে।
সম্বলপুরবাসিনী শ্যালিকার আর একখানি পত্র পাইলাম। তিনি অন্য নানা কথার পর লিখিতেছেন:
‘প্রভা সতীলক্ষ্মী ভাগ্যবতী ছিল। সে গেছে, বেশ গেছে। জাজ্বল্যমান স্বামী, ছেলেপুলে সব রেখে গেছে। কিন্তু তোমার তো তা বলে সংসারটা ছারখার করা ভালো দেখায় না। উচিতও নয়। আমার কথা শোনো। আবার বিয়ে করো তুমি।…এখানে একটি বেশ ডাগরডোগর মেয়ে আছে। যদি তোমার ইচ্ছে হয় বলো, সম্বন্ধ করি। আমার তো মেয়েটিকে বেশ পছন্দ। তোমার নিশ্চয়ই পছন্দ হবে।’ ইত্যাকার নানারূপ কথা।
সাত দিন ভাবিয়া—অর্থাৎ এক টিন চা ও পাঁচ টিন সিগারেট নিঃশেষ করিয়া আমি এই চিরন্তন সমস্যার যে মীমাংসা করিলাম, তাহা মোটেই অসাধারণ নয়। সেজদিকে যে পত্র দিলাম, তাহা অংশত এইরূপ—
“বিয়ে করতে আর ইচ্ছে হয় না। প্রভার কথা সর্বদাই মনে পড়ে। কিন্তু দেখ সেজদি, আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপর নির্ভর করে তো সংসার বসে নেই। সে আপনার চালে ঠিক চলছে ও চলবে। সুতরাং ভাবপ্রবণ হওয়াটা শোভন হলেও সুযুক্তির নয়—এটা ঠিকই। তা ছাড়া দেখ, আমরা ‘মা ফলেষু কদাচ’ দেশের লোক। আর তোমরাও যখন বলছ, তখন আর একবার সংসারটা বজায় রাখবার চেষ্টা করাই উচিত বোধহয়। দ্বিতীয়পক্ষের বিয়েতে আবার পছন্দ-অপছন্দ! তোমার পছন্দ হয়েছে তো?”
ক্রমশ বিবাহের দিন স্থির হইল। সম্বলপুরেই বিবাহ। সেজদি বুদ্ধিমতী। লিখিয়াছেন, ‘ছেলেদের লাহোরে বড়দির কাছে পাঠিয়ে দিলাম। বাপের বিয়ে দেখতে নেই।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিলাম।
যথাকালে সাহেবের হাতেপায়ে ধরিয়া হপ্তাখানেকের ছুটি লইয়া সোজা রওনা হইয়া পড়িলাম। একাই। এ বিয়ের কথা কাউকে বলিতে আছে? কী ভাবিয়া গোঁফটা কামাইয়া ফেলিলাম। একে এই কালো মোটা চেহারা, তাহার ওপর কাঁচা-পাকা একঝুড়ি গোঁফ লইয়া বিবাহ করিতে যাইতে নিজেরই কেমন বাধবাধ ঠেকিতে লাগিল।
বিবাহবাসর।
ওই অবগুণ্ঠিতা চেলিপরা মেয়েটিই আবার আমার সঙ্গিনী হইতে চলিয়াছে। প্রভাকেও একদিন এইভাবেই পাইয়াছিলাম, সে কোথায় চলিয়া গেল। আজ আবার আরেকজন আসিয়াছে। ইহার কিডনি কেমন কে জানে। নানারূপ এলোমেলো কথা মনে আসিতে লাগিল। প্রভার মুখ বারবার মনে পড়ে। ছেলেগুলো না জানি এখন কী করিতেছে। মৃত্যুর পরও কি আত্মা সত্যি থাকে?…এ মেয়েটি বেশ বড়সড় দেখিতেছি, কিন্তু ভারি জড়সড় হইয়া বসিয়া আছে—একেবারে মাথা নিচু করিয়া। আচ্ছা, প্রভার আত্মার যদি…গৃহ্নামি গৃহ্নামি…
যন্ত্রচালিতবৎ বিবাহ অনুষ্ঠান চলিতে লাগিল। শুভদৃষ্টির সময় মেয়েটি কিছুতেই ঘোমটা খুলিল না। সেজদি বলিলেন, ভারি লাজুক! বাসরঘরেও শুনিলাম, ভারি লাজুক! আপাদমস্তক মুড়িয়া পাশ ফিরিয়া শুইল। আমিও ঘুমাইলাম। সেজদি লোক জমিতে দেন নাই। তা ছাড়া দ্বিতীয়পক্ষের বিবাহ, কে আমোদ-প্রমোদ করিতে চায়। মেয়েটির আপন বলিতে কেহ ছিল না। পরের বাড়িতে মানুষ। সেজদির বাড়িতেই বিবাহ, বলিতে গেলে সেজদিই কন্যাকর্তা। সুতরাং বিবাহ-উৎসব জমে নাই।
জমিল ফুলশয্যার রাত্রে।
বক্ষে অনেক আশা ও আশঙ্কা লইয়া ঘরে ঢুকিয়া দেখি, আমার ছয়টি সন্তান ও আরও এক নবজাতক শিশু লইয়া স্বয়ং প্রভা খাটে বসিয়া। স্বপ্ন দেখিতেছি নাকি? প্রভা কহিল—‘ছিঃ, ছিঃ, সেজদিরই জিত হলো?’
তার মানে?
“মানে আবার কী? এবার ছেলে হওয়ার সময় ভারি কষ্ট হয়েছিল। অপরাধের মধ্যে সেজদিকে বলেছিলাম যে আমি মলে ওঁর ভারি কষ্ট হবে। সেজদি বললে, ‘হাতি হবে। তিন মাস যেতে না-যেতে ফের বিয়ে করবে।’ আমি বললাম, ‘ককখনো নয়!’ তারপর বাজি রেখে সেজদি আর বিনোদ মিলে এই ষড়যন্ত্র! আমি শান্তিপুরেই ছিলাম। আজ এই সন্ধ্যাবেলা এসেছি। এসে দেখি সেজদিরই জিত। পাড়ার মানকে ছোঁড়াকে কনে সাজিয়ে সেজদি বাজি জিতেছে। একশটি টাকা দাও এখন। ছিঃ ছিঃ, কী তোমরা! অমন গোঁফটা কী বলে কামালে?”
আমার অবস্থা অবর্ণনীয়।
পরদিন প্রভাতে সেজদির পাওনা চুকাইয়া দিয়াছি। এখন গোঁফটা উঠিলে যে বাঁচি।
বনফুল: আসল নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক ছদ্মনাম বনফুল। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন চিকিৎসক। ‘শনিবারের চিঠি’তে ব্যঙ্গ কবিতা ও প্যারোডি লিখে সাহিত্যজগতে প্রবেশ। জন্ম ১৮৯৯, মৃত্যু ১৯৭৯।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২৫, ২০১১
Leave a Reply