কাব্য প্রতিভার জন্য রাজুর নাম প্রথমে ছিল ‘কবিরাজু’; শেষমেশ হলো ‘কবিরাজ’! তার লিটল ম্যাগাজিনের প্রথম কিস্তি প্রকাশের পরই এলাকার মুরব্বিদের টনক ডিগবাজি দিতে শুরু করল। মহল্লার কচিমনের বাচ্চাগুলোকে কবিতারূপী ফরমালিন দিয়ে পাকানোর ষড়যন্ত্র চলছে! যেকোনো উপায়ে ষড়যন্ত্রের এই নীলনকশাকে হোয়াইটওয়াশ করতে হবে। মিটিং বসল, সমাবেশ চলল। এসব দেখেও কবিরাজ দমার পাত্র নয়। একবেলা কবিতা না লিখলে তার কেমন যেন লাগে; মনে হয়, ‘রয়ে গেল তো পুষ্টি বাকি’!
প্রতি ভোরের মতো আজও কবিরাজ সূর্যস্নান করতে বারান্দায় এল (সংবিধিবদ্ধ উপকারী তথ্য: সোলার এনার্জিতে ভাইটামিন আছে)। সামনের বাড়ির ছাদে তাকানো মাত্রই তার হূৎকম্পন রিখটার স্কেলে একেবারে ৯ দশমিক ৫! এমন কাব্যিক চেহারার মেয়ে সে আগে দেখেনি; নতুন ভাড়াটে মনে হয়। কতশত মেয়ে কবিরাজের সঙ্গে ভাববিনিময় করতে হাঁ করে প্রহর গুনছে (এটি কবিরাজের একান্তই ব্যক্তিগত ধারণা); অথচ এই মেয়েকে দেখে তার মনের আঙিনায় সিডর শুরু হয়ে গেল! এরই নাম বুঝি ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’—‘কানা ভালোবাসা’!
কবিরাজ তার জানিদোস্ত ‘ছড়া টুটুল’কে প্রভাত-প্রেমের ঘটনা আবৃত্তি করে শোনাল। শুনে তো ছড়া টুটুলের তোতলামি যেন ছন্দ খুঁজে পেল! ‘আ-আ-আমি এসবে নাই, অ্যা-অ্যা-এখন তবে যাই।’ বন্ধুর পৃষ্ঠ প্রদর্শনে অভিমানে কবিরাজের হূৎপিণ্ড খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাওয়ার দশা! হঠাৎ মনে পড়ে গেল কবিগুরুর কথা। গুরু বলেছেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে’।
বিকেলেই কবিরাজ মেয়েটির বাসায় গিয়ে হাজির। মেয়ের নাম নীলা। সে নীলাকে তার লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা দেওয়ার জন্য নানাভাবে বোঝাল। ‘আমি কী বিশ্বাস করি, জানো? পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কোনো দেশের মধ্যে হবে না। যুদ্ধ হবে ভালোবাসা আর ঘৃণার মধ্যে! আমি ভালোবাসার পক্ষে। আমার কবিতার পত্রিকাটিও প্রেমের বাণী ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিটি সিলিকা কণায়, ইথারের পরতে পরতে। এবারের সংখ্যায় তুমি কবিতা লিখবে; আর তোমার কবিতা ছাপা হবে প্রচ্ছদে। ঠিক আছে মেয়ে? কাল কিন্তু কবিতা নিতে আসব।’ অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাগুলো বলল কবিরাজ। নীলা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না, কী বলবে। তার কিংকর্তব্যবিমূঢ় চাহনি দেখেই কবিরাজের সিক্সথ সেন্স বলছে যে নীলা নামের মেয়েটি তার প্রেমে পড়েছে।
কবিরাজ অন্য সব প্রেমিকের মতো ক্ষুধামন্দা আর ঝিমানি রোগে আক্রান্ত হলো! রাতে খেতে ইচ্ছা করল না। ঠিকমতো ঘুমও এল না। কল্পনায় নীলাকে নিয়ে সে সমুদ্র ভ্রমণে গেল, বৃষ্টিবিলাস করল, সূর্যের ভিটামিন খেল, জ্যোৎস্নার আলো ধরল, আরও কত কি! কুসুম কুসুম ভালোবাসায় অবস্থা অমলেটময়! বেচারার সংকটাপন্ন অবস্থা দেখে প্রকৃতির মায়া হলো, ভোররাতে দুই চোখজুড়ে ঘুম নেমে এল। কিন্তু ঢেঁকি যে স্বপ্নেও ধান ভানে! এবার একধাপ এগিয়ে; ফিউচার পার্কে ফিউচার ফ্যামিলির স্বপ্ন!
পরদিন সূর্যিমামা ঘাড়ে চেপে বসার আগেই কবিরাজকে দেখা গেল, নীলাদের সোফায় বসে আছে। আজ নীলার সঙ্গে ছোট্ট একটি মেয়েও ঘরে ঢুকল। এ তো দেখি ‘প্লাটিনামে সোহাগা’ (‘সোনায় সোহাগা’ বাগধারার আধুুনিক ভার্সন); শ্যালিকা না থাকলে কি সম্পর্ক জমে! নীলার ছোট বোন আছে জানলে কবিরাজ এক প্যাকেট চকলেট নিয়ে আসত। যা-ই হোক, নীলার সঙ্গে কবিতা নিয়ে আলোচনা যখন জমে উঠেছে, তেমনি এক শুভক্ষণে ছোট্ট মেয়েটি ‘মা, মা’ বলে কেঁদে উঠল। কবিরাজের তো মাথায় বাজ!
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ১৮, ২০১১
Leave a Reply