চায়ের দোকানের বেঞ্চটায় আরাম করে বসে আছি। আমি এই দোকানের নিয়মিত ক্রেতা। দেশ থেকে লজ্জাশরম প্রায় উঠে যাচ্ছে দেখে বাকিতে চা খেয়ে দোকানদারকে কিঞ্চিৎ লজ্জা দিই। দোকানদারটাও এত ভালো যে লজ্জায় বাকির টাকা চাইতে পারে না। হঠাৎ দেখি, রবিন আসছে। আমার পাশে মুখ গোমড়া করে বসে পড়ল ও। বললাম, ‘মন খারাপ কেন? বউ মারা গেছে?’
‘বউ মারা গেলে কাউকে কখনো মন খারাপ করতে দেখেছিস? এটা তো আনন্দের সংবাদ!’
আমি মাথা নাড়লাম। রবিনের কথায় যুক্তি আছে। কয়েক দিন আগে যুক্তিবিদ্যার শিক্ষক সাইদ আজমল রবিনদের নিচতলার ফ্ল্যাটে উঠেছেন। তার পর থেকেই দেখছি, রবিন বেশ যুক্তিসংগত কথা বলছে। সে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘২৫ হাজার কর্মহীন এনজিওর মতো তোরও কোনো কাজ নেই। সারা দিন চায়ের দোকানে বসে থাকিস।’
‘চায়ের দোকানে বসে থাকা যাবে না, এমন কোনো আইন কি প্রচলিত আছে?’
‘তা নেই, তাই বলে এলাকার খবর রাখবি না? এলাকায় একটা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে। সে অনুষ্ঠান নিয়ে গ্যাঞ্জামও লেগেছে। আর তুই বসে আছিস?’
‘গ্যাঞ্জাম লাগলে বাদ দে। তোরা বরণ না করলেও বর্ষ আসবে। কেউ তাকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’
‘নতুন বছর আসবে, আর আমরা বসে বসে মুড়ি খাব, তা হবে না। সব ঠিকই এগোচ্ছিল। উপস্থাপক হিসেবে রিপা আপুকে রাজি করিয়েছিলাম। ভাই ভাই ডেকোরেটর থেকে চেয়ার-টেবিল ভাড়া নিয়েছি। মঞ্চটাও ওরাই সাজাবে। ভেজালটা করেছে শফিক ভাই।’
‘সেকি! আমি তো জানতাম উনি কিছুই পারেন না।’
‘উনি যে রিপা আপুর জন্য পাগল, তা তো জানিস। হঠাৎ বলে বসলেন, রিপা আপুর সঙ্গে উনিও উপস্থাপনা করবেন। ওদিকে রিপা আপু তো কিছুতেই রাজি না। উল্টো মজা করে বললেন, “আপনার যে কণ্ঠ, তাতে উপস্থাপনা নয়, কবিতা আবৃত্তি করা উচিত।” ব্যাস, শফিক ভাই ঠিক করলেন, অনুষ্ঠানের শুরুতেই রবিঠাকুরের “বৈশাখ” কবিতা আবৃত্তি করবেন। শুধু তা-ই নয়, ক্লাবঘর দখলে নিয়ে অনুশীলনও শুরু করে দিয়েছেন।’
‘তাতে সমস্যা কী?’
‘আরে গাধা! তাঁর গলার আওয়াজে ক্লাবঘরের ইঁদুরগুলো সপরিবারে পালিয়েছে। দেয়ালের চুনও খসে পড়েছে। এই কণ্ঠ নিয়ে আবৃত্তি করলে পাবলিক তো পাইকারিভাবে জুতা মারবে। অনেক টাকা জোগাড় করে দিয়েছেন; তাই তাঁকে বাদও দিতে পারছি না। অনুষ্ঠানের আছে আর দুই দিন। আমার মাথায় পুরো সৌরজগৎ ভেঙে পড়েছে। আমাকে বিপদ থেকে বাঁচা।’
‘আমি নিজেই বিপদে আছি। তোকে কী বাঁচাব? চায়ের দোকানদার ১৫২ টাকা পায়। তা দিতে পারছি না বলেই সারা দিন দোকানে বসে থাকি। ওকে সান্ত্বনা দিই।’
‘টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি। তুই ওঠ।’
রবিনের মানিব্যাগ থেকে ভিজিটিং কার্ড ছাড়া অন্য কিছু কখনো বেরিয়েছে বলে মনে হয় না। আর সেই রবিন মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিল! জগৎ বড়ই রহস্যময়!
ক্লাবঘরের সামনে এসে দেখি জায়গাটা খাঁ খাঁ করছে। অথচ এ জায়গায় অনেকেই রাজনৈতিক আলোচনা করত। রবিন বলল, ‘দেখেছিস, কোনো লোকজন নেই। শফিক ভাইয়ের আবৃত্তি শুনে সবাই পালিয়েছে।’
আমরা বাইরে থেকেই কর্কশ কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি। ভেতরে গেলে কী হবে কে জানে। তবুও গেলাম। আমাদের দেখেই শফিক ভাই বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘কী ব্যাপার! অনুশীলনের সময় আমি কোনো আলোচনা করি না।’
বললাম, ‘ভাই, আপনার আবৃত্তি শুনতে এসেছি।’
উনি তো মহা খুশি। এ প্রজন্মের তরুণদের অবক্ষয়সংক্রান্ত একটা লেকচারও দিয়ে দিলেন। তারপর শুরু করলেন সেই আবৃত্তি—
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!
ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,
তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল
কারে দাও ডাক
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!
বাপ রে! ভয়াল আবৃত্তি শুনে আমাদের ইচ্ছা করছিল ভৈরব নদীতে ঝাঁপ দিতে। সাঁতার জানি না বলে তা বাদ দিয়ে হাততালি দিলাম। শফিক ভাই হেসে বললেন, ‘শুধু তালি? বল কী খাওয়াবি?’
আমি রবিনের দিকে চোখ টিপে বললাম, ‘আইসক্রিম খাবেন?’
‘না না, আইসক্রিম নয়, এখন সাধনার সময়।’
‘হু, রিপা আপুও তা-ই বলছিল।’
শফিক ভাই সতর্ক হয়ে বললেন, ‘কী বলছিল?’
‘বলছিল, আপনি আইসক্রিম খেতে ভয় পান। বাজি ধরে আইসক্রিম খেলে আপনি রবিনের সঙ্গেই পারবেন না। এসব আরকি।’
‘চল, আইসক্রিম খাব। আজ আমার একদিন কি ইগলু কোম্পানির একদিন।’
দোকানে এসে শফিক ভাই একটার পর একটা আইসক্রিম খাওয়া শুরু করলেন। অবস্থা এমন যে আমরা একটা খেতে খেতে তিনি তিনটি খেয়ে ফেলেন। তারপর প্রায় ১০টির মতো আইসক্রিম খেয়ে রণেভঙ্গ দিলেন। আমরা মহানন্দে তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করলাম। শফিক ভাই বিল দিতে দিতে বললেন, ‘রিপাকে বলিস কে কয়টা আইসক্রিম খেয়েছে।’
‘অবশ্যই। আপনি যে বিল দিয়েছেন এটাও বলব। কিন্তু ভাই, কই যান? রিহার্সেল?’
‘গলাটা একটু ব্যথা করছে তো…’
‘রিপা আপুও তা-ই বলছিল…’
‘চল, যত বাধাই আসুক, অনুশীলন চলবেই।’
কিন্তু অনুশীলন বেশিক্ষণ চলল না। কিছুক্ষণ চেঁচানোর পর গলা দিয়ে আওয়াজই বের করতে পারলেন না শফিক ভাই। ঘড়ঘড় করে আমাদের বললেন, ‘আসলে এত আইসক্রিম খাওয়া ঠিক হয়নি। ঝোঁকের বশে খেয়ে এখন গলা ব্যথায় মারা যাচ্ছি। আমার আর আবৃত্তি করা হবে না রে!’
আমি বললাম, ‘আপনি রেস্ট নেন। গরম পানি আর আদা-চা খান। আবৃত্তি আমরাই করে দেব।’
‘তা-ই কর। তবে ছন্দগুলো ভুল করিস না আবার। আমি যাই।’
শফিক ভাই চলে যেতেই রবিন আমার পিঠে কিল দিয়ে বলল, ‘বাঁচলাম! তোর মাথায় এত বুদ্ধি কী করে আসে?’
‘কেন? চায়ের দোকানে বসে থেকে।’
আনন্দে আমরা একসঙ্গে আবৃত্তি শুরু করলাম—হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!…
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ১১, ২০১১
Leave a Reply