ভিকারুননিসা নূনেই আমার স্কুল-কলেজের দিন শেষ হয়েছে। কত স্মৃতি, কত ছোট ছোট হাসি-মজা, তবে আজও যেদিনটির কথা মনে পড়লে নিজের অজান্তেই হেসে উঠি, সেটি ছিল ক্লাস টেনের একটি দিন। যেহেতু আমাদের এসএসসির সিলেবাস ক্লাস নাইন আর টেন মিলিয়ে শেষ করা হয়, তাই ক্লাস টেনের শেষে সেভাবে আর কোনো নতুন পড়া থাকে না। আর বলাই বাহুল্য, সবচেয়ে নীরস বিষয় ছিল বাংলা। আর তাই ক্লাস পালানোর জন্য আমরা বাংলাই বেছে নিয়েছিলাম। আমাদের বাংলা ক্লাসগুলো গদ্য, পদ্য, উপন্যাস, নাটক—এভাবে ভাগ করা থাকত। সেদিন টিফিন পিরিয়ডের পরের ক্লাসটা ছিল বাংলা পদ্য। তাই আমরা ইচ্ছা করেই টিফিন পিরিয়ডের সময়টা কারও অনুমতি ছাড়াই বাড়িয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু একসময় না একসময় তো ক্লাসে ঢুকতেই হবে। কারণ আমাদের বেশিক্ষণ ক্লাসের বাইরে থাকাটাও বিপজ্জনক। যখন তখন পিটি আপার কাছে ধরা খাওয়ার আশঙ্কা ১০০ ভাগ। আমরা মানে আমি, আতিয়া, খাদিজা, শর্মিষ্ঠা, টুকটুক, দোলা, দিশা যখন ক্লাসে ঢুকলাম, তখন পদ্য ক্লাসের আর ১০ মিনিট বাকি। আমাদের পদ্য আপা একটু বয়স্ক আর খুব নরম প্রকৃতির ছিলেন, তাই আমরা ভেবেছিলাম পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে যার যার জায়গায় বসে পড়লেই তিনি আর কিছু করতে পারবেন না। তো যেই আপা বোর্ডে লেখার জন্য উল্টো ঘুরেছেন, অমনি আমরা সবাই হুড়মুড় করে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লাম। আমাদের সিট শেষের দিকে ছিল। কিন্তু ভাগ্যটা বলতে গেলে আমারই খারাপ ছিল। আমার আগেই সবাই ঢুকে যার যার সিটে বসে পড়ল আর মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো আমিই বাদ পড়লাম। কারণ, শয়তান দিশা আমার সিটে বসে পড়েছিল। আমি সিটের সামনে গিয়ে হাবার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম আর দিশাকে বলছিলাম উঠে যেতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! এর মধ্যে আপাও বোর্ডে লেখা শেষ করে চেয়ারে বসে পড়েছেন। আপার কাছে যাতে ধরা না পড়ি তাই সব বান্ধবী মিলে আমাকে মাটিতে বসিয়ে দিল। আমাদের বেঞ্চের সারিটা ছিল ক্লাসের একদম শেষে আর আমাদের সারির সামনে একজন বসে পড়ার মতো যথেষ্ট জায়গা ছিল। কিন্তু তাতেও আমার শেষ রক্ষা হলো না। কারণ, আপা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আপার চোখে যাতে না পড়ি তাই আমার দয়াবতী বান্ধবীরা(!) আমাকে সবার ব্যাগ আর সোয়েটার দিয়ে ঢেকে দিল। ভাগ্যিস তখন শীতকাল ছিল। কিন্তু আমার এ অবস্থা দেখে আশপাশে সবার হাসি চেপে রাখতে বড়ই কষ্ট হচ্ছিল আর আমার অবস্থা না-ই বললাম! এরই মধ্যে শুনি, আপা বলছেন, ‘তুমি উঠে এসো, তুমি উঠে এসো…।’ আমাদের সবার তো ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। এখন কী হবে! কী আর হবে, ধরা পড়াই ভাগ্যে ছিল—এই চিন্তা করে যখন আমি উঠে দাঁড়াতে যাব, তখন শুনি আপা বলছেন, ‘মাঝিমাল্লার দলে, দেখবে তোমার কিশতি আবার ভেসেছে সাগরজলে।’ এটা শোনার পর আমাদের কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো। আপা আসলে ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতাটি পড়াচ্ছিলেন আর আমরা যে দুটি লাইন শুনেছিলাম তা ওই কবিতাটির লাইন ছিল।
নাজিয়া চৌধুরী
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, মহাখালী, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৮, ২০১১
Leave a Reply