স্কুলে ইঁচড়ে পাকা হিসেবে আমার কুখ্যাতি ছিল। পরীক্ষার ফল যা-ই হোক, মেয়ে পটানোতে ছিলাম ওস্তাদ। প্রেমপত্র চালান দিতাম যখন-তখন। তাতে কাব্যপ্রতিভা এবং সাহিত্যচর্চা পাল্লা দিয়ে বাড়ত। বন্ধুরা যখন গোয়েন্দা কাহিনি, রহস্যোপন্যাস আর ভৌতিক গল্প নিয়ে পড়ে আছে, তখন আমি সেসবের পাট চুকিয়ে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র আর হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস নাড়াচাড়া করছি। পত্রিকায় লেখা পাঠাতাম। প্রথম প্রথম একটাও ছাপেনি। কিন্তু যেদিন এক কবির কবিতা থেকে শব্দ ধার করে ‘প্রেম’, ‘প্রিয়া’, ‘চুম্বন’-জাতীয় শব্দ জুড়ে দিয়ে বানানো একটা কবিতা পাঠালাম, অমনি ছেপে দিল। বুঝলাম, প্রেমবিষয়ক লেখায় আমার হাত আছে। কিন্তু পত্রিকার সম্পাদক তো কল্পনায় বিচরণকারী বালিকা নন যে তাঁর নজর কাড়তে এসব লেখা; বরং ছাপালেই অনেক। ছাপা হয়েছিল দু-চারটা। ধৈর্যও ধরতে হয়েছে অনেক। তাই মজাটা কম। কিন্তু ক্লাসের অকালপক্ব বালিকাদের প্রতি প্রেমপত্র পাঠালে সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রতিক্রিয়া তো পাওয়া যায়। তাই লিখে ফেললাম পাতা ভরে। তাতে লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ প্রসঙ্গ আর প্রেমের পক্ষে এমন সব যুক্তি দিলাম যে সেটা প্রেমপত্র না হয়ে প্রবন্ধ ধরনের হয়ে গেল। ব্যবহার করলাম জটিল সব উপমা। সবকিছুই ধার করা। তার অনেকটা আমি নিজেই বুঝতাম না। আমার সেই গদ্য-পদ্য মিলিয়ে পাঁচমিশালি মহাকাব্য দেখাতাম সখিনাকে। ‘বাহু যেন সাক্ষাৎ মুলো’—লাইনটা নিয়ে সখিনা যেদিন আপত্তি তুলল, সেদিন মুলো নামক সবজির সাদা রং আর সখিনার উজ্জ্বল ফর্সা ত্বকের মিল দেখিয়ে কোনো রকমে পার পেয়েছিলাম। কাজেই কবিতা কাটছাঁট করে ফেললাম। তারপর কী মনে করে পাঠিয়ে দিলাম সেই পত্রিকায়। অথচ সখিনাকে মুগ্ধ করাই ছিল আমার লক্ষ্য। সোমবার বেরোল সেই পত্রিকা। সেটা সংগ্রহ না করেই স্কুলে গেলাম। সম্পূর্ণ লেখাটা সখিনাকে দেখাতে হবে। ক্লাসের মধ্যেই আমার লেখাটায় নজর বুলিয়ে নিলাম। ১৫টা বানান ঠিক করলাম। তখন কিছু না বুঝতেই বদরুল স্যার কাগজটা ছোঁ মেরে নিয়ে গেলেন। পড়তেই কটমট করে তাকালেন, বললেন, ‘কাল তোর বাবাকে ডাকবি।’ তারপর কী হলো আর না-ই বললাম। কিন্তু এটা ভাবতেও পারিনি যে আমার লেখাটা সেদিনই পত্রিকায় এসেছে। দুর্নাম ঘোচাতে পত্রিকাটা দিলাম বাবার হাতে। নিয়ে গেলেন স্কুলে। সেদিন থেকেই ইঁচড়ে পাকা লেবেলটা ভালোভাবে লেগে গেল কপালে। মন্দ কী! সখিনাকে দেওয়ার সময় হাতেনাতে ধরা তো পড়িনি। ইভ টিজারের চেয়ে ইঁচড়ে পাকা অনেক ভালো।
রাসেল
শেরেবাংলা হল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৮, ২০১১
Leave a Reply