[কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক]
‘বলতে পারো “সদাচার” কী?’ প্রশ্ন করল, কেসি মেমোরিয়াল হাইস্কুলের জুনিয়র শিক্ষক মাসুদ রানা। দুর্ধর্ষ কিংবদন্তি স্পাই মাসুদ রানা এখন স্কুলশিক্ষক।
‘ইহা এমন এক প্রকার আচার, যা আমাদের স্কুলের সামনের দোকানে বিক্রি হয় না।’ চটপট উত্তর দিল ছাত্রটি।
সবাই হেসে উঠল। গম্ভীর মুখে আরেকজনকে প্রশ্ন করল রানা, ‘বলো তো, ট্রান্সপারেন্ট শব্দের মানে কী?’
‘স্বচ্ছ।’ উত্তর দিল ছাত্রটি।
‘উদাহরণ দাও?’
‘যেমন—আপনার পুরোনো পাঞ্জাবিটি এত স্বচ্ছ যে আপনি ভেতরে ছেঁড়া লাল স্যান্ডো গেঞ্জি পরেছেন, তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে!’ সবাই হেসে উঠল আবার। উদাস হয়ে গেল রানা।
দুই.
এক সপ্তাহ আগের ঘটনা। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কর্ণধার মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান এক মাস হলো আমেরিকায় গেছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমন্ত্রণে। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ওবামা হিমশিম খাচ্ছেন বলে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন তাঁকে।
বিসিআই চালাচ্ছে এখন রানার বন্ধু সোহেল। প্রজেকশন হলে বসে আছে দুজন। এইমাত্র বেশ কয়েকজন মেয়ের ছোটবেলার ছবি দেখা শেষ করল দুজনে।
‘নায়িকা শাবদুর, ভারতের নায়িকা পারভিন, আমাদের সোহানা—হঠাৎ এদের ছোটবেলার ছবি দেখালি কেন?’ রানা জিজ্ঞেস করল।
‘কারণ, এরা সবাই মিসিং!’ নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল সোহেল।
‘হোয়াট!’
‘ঠিকই শুনেছিস! হঠাৎ করেই এরা বাতাসে মিলিয়ে গেছে। আর একটা ছবি দ্যাখ।’ ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ছোট্ট সোহানা একটা স্কুলের গেট দিয়ে বের হচ্ছে। পরের ছবিতে আইসক্রিম কিনছে ও। চোখে প্রশ্ন নিয়ে রানা তাকাল সোহেলের দিকে। কাঁধ ঝাঁকাল সোহেল। ‘হঠাৎ করেই ও শৈশবে পৌঁছে গেছে। খবিশ চৌধুরী মেমোরিয়াল স্কুলে পড়ছে সোহানা। আমাদের এক্সপার্ট ডা. শমসের আলী বলেছেন, কেউ হয়তো যুগান্তকারী কোনো আবিষ্কার করে ফেলেছে। যার জন্য সোহানা ছোট্ট হয়ে গেছে।’
‘খবিশ চৌধুরী নামটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে!’ বলল রানা।
‘ঠিকই ধরেছিস। কবির চৌধুরীর বাবার নাম ওটা।’
‘আমরা তো সোহানাকে স্কুলের গেট থেকে তুলে আনতে পারি?’ বলল রানা।
‘সে চেষ্টা করেছিল গিলটি মিয়া। বেচারা ইভ টিজিংয়ের দায়ে গণধোলাই খেয়ে এখন হাসপাতালে।’
‘তাহলে আমি কীভাবে ঢুকব ওই স্কুলে?’ প্রশ্ন করল রানা।
‘শিক্ষকের চাকরি নিয়ে।’ পকেট থেকে পেপার কাটিং বের করে দিল সোহেল।
‘চাকরি তো আমার নাও হতে পারে।’ হেসে বলল রানা।
‘হবে। টেন্ডারবাজির মতো ব্যবস্থা করব। শুধু তুই একাই ভাইভা বোর্ডে হাজির হবি।’
তিন.
এক ছাত্র উঠে দাঁড়াল, ‘স্যার, আমি একটু ল্যাপট্রিনে যাব।’
‘কী বললে? অবাক হলো রানা।
‘ল্যাপট্রিন স্যার, ল্যাপট্রিনে যাব।’
‘তোমার সব পড়া হয়েছে।’
‘হয়নি স্যার। বাসায় রাতে ইলেকট্রিটিটি ছিল না।’ বলল ছাত্রটি।
বুঝতে পারছে রানা—সমস্যা অন্য কোথাও।
‘তোমাকে ইংরেজি শেখায় কে?’ প্রশ্ন করল রানা।
‘আমার বাবা, নয়তো দাদু!’
‘তোমার বাবাকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবে।’ বলল রানা।
পরদিন ছেলেটির বাবা স্কুলে এলেন।
‘আপনার ছেলে তো ভুল ইংরেজি বলে।’ অনুযোগ করল রানা।
‘ছোট বাচ্চা, বুঝলেন তো, ক্যাপাটিটি কম!’ হেসে বললেন ভদ্রলোক।
‘আপনার আব্বাও কি ইংরেজি জানেন?’
‘জানেন।’ উত্তর দিলেন ভদ্রলোক।
‘তাঁকে একদিন আসতে বলুন তো।’
পরদিন ছাত্রটির দাদু এসে উপস্থিত হলেন। রানা তাঁকে বসিয়ে বলল, ‘আপনার ছেলে, নাতি দুজনেই তো ভুলভাল ইংরেজি বলে, ব্যাপার কী?’
এক গাল হেসে দাদু বললেন, ‘আরে ওর বাপ-দাদা তো আর ইউনিভার্টিটিতে পড়েনি।’
চার.
ধীরে ধীরে চোখ মেলল রানা। আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল ওর। স্কুলের বেশ কিছুটা পেছনে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান কে চৌধুরীর বাসার গেটে কড়া পাহারা। কেউ সেখানে যেতে পারে না। কে চৌধুরী বিদেশে থাকায় বাসা দেখাশোনা করেন তাঁর আত্মীয় সাগর চৌধুরী ও স্কুলের আরেক জুনিয়র শিক্ষক। সোহানা তাঁর সঙ্গেই থাকে।
রানা রাতে চুপ করে ঢুকতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে। জ্ঞান ফিরে পেল এই মাত্র।
চারদিকে তাকাল রানা। ছোট্ট সোহানা বিছানায় শুয়ে আছে। রানা শুয়ে আছে ডিভানে। সারা শরীর অবশ। নড়তে পারছে না।
‘কেমন আছো রানা?’ গলাটা কেমন চেনা চেনা মনে হলো রানার কাছে। কয়েক দিন ধরেই ক্লাসে আর স্কুলের বারান্দায় সোহানার সঙ্গে কথা বলেছে রানা। ছোট সোহানা বয়সের সঙ্গে স্মৃতিশক্তিও হারিয়েছে। চিনতে পারেনি ওকে।
‘চিনতে পারছো, রানা আমাকে?’ কবির চৌধুরীর গলা। সুঠাম দেহের তরুণ সাগর চৌধুরীকে দেখে চেনার উপায় নেই যে এই হচ্ছে মাসুদ রানার আদি শত্রু পাগল বিজ্ঞানী কবির চৌধুরী।
হাসল চৌধুরী, ‘দেখেছ, কী যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছি। নিজের বয়স কমিয়েছি। তোমার প্রেমিকা সোহানাকে বাচ্চা বানিয়ে দিয়েছি।’
‘কেন?’ প্রশ্ন করল রানা।
‘আমি জানতাম, ভিলেনের ভঙ্গিতে বলল চৌধুরী, কান টানলে মাথা আসবেই। তাই সোহানাকে ধরে আনলাম। জানতাম, তুমি আসবেই। এসেছ।’
‘তাতে তোমার লাভ কী হলো?’
‘দেখো রানা, যতবারই আমি আমেরিকাকে শায়েস্তা করতে চেয়েছি, ততবারই তুমি বাগড়া দিয়েছ। আর পারবে না।’ ঘুমন্ত সোহানাকে ইনজেকশন দিল চৌধুরী। তারপর বলল, ‘সোহানা আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই তার আগের শরীর আর স্মৃতি ফিরে পাবে। আর তুমি?’ টেবিল থেকে আরেকটা ইনজেকশন তুলে নিয়ে ক্রুর হাসি হাসল চৌধুরী, ‘দুর্ধর্ষ স্পাই মাসুদ রানা এখন হয়ে যাবে ফিডার খাওয়া বাচ্চা। স্মৃতি অটুট থাকবে তোমার কিন্তু শরীর হবে বাচ্চার।’ বলতে বলতে চৌধুরী ইনজেকশনটা ঢুকিয়ে দিল রানার শরীরে।
পাঁচ.
সোহেলের হাতে দুগালে থাপড় খেয়ে জ্ঞান ফিরল সোহানার। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল সে। তারপর ধড়মড় উঠে বসল, ‘আরে, সোহেল তুই! আমি কোথায়?’
‘রানা কোথায়? কবির চৌধুরী কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল সোহেল।
‘জানি না তো।’ বলল সোহানা। ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল বাচ্চা রানা। ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। কবির চৌধুরী পালিয়েছে—সেটা বলতে পারছে না।
‘বাচ্চাটা কার?’ সোহেল জিজ্ঞেস করল।
‘জানি না। কার না কার বাচ্চা!’
‘চল দুজনে রানা আর চৌধুরীকে খুঁজে বের করি।’
বিশ্বজিৎ দাস
প্রভাষক, দিনাজপুর সরকারি কলেজ।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৮, ২০১১
Leave a Reply