বছর দুই আগের কথা। হূদরোগে আক্রান্ত এক বন্ধুকে নিয়ে কলকাতায় গেছি চিকিৎসার জন্য। কলকাতার নামকরা এক হাসপাতাল। বন্ধুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, আমি হাসপাতালের লবিতে বসে পত্রিকা পড়ছি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সব পত্রিকা পড়ে শেষ করে ফেললাম। এরপর হাসপাতালের লিফলেট পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করলাম মাত্র এক হাজার ৫০০ টাকায় এখানে থরো চেকআপের ব্যবস্থা আছে। ভাবলাম, বিদেশের হাসপাতালে যখন ভাগ্যক্রমে এসেছি, তাহলে থরো চেকআপটা করেই ফেলি। থরো চেকআপ করতে গিয়ে দেখা গেল আমার হার্ট মিনিটে মাত্র ৪৬ বার কম্পিত হয়, যেখানে স্বাভাবিক হার্টবিট হচ্ছে ৬০ থেকে ১০০। এই অসুখের নাম ব্রাডিকার্ডিয়া। মোটামুটি ভয়াবহ ধরনের অসুখ। ওদিকে তাবৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা গেল আমার বন্ধুর হার্ট পুরো ফিট, তবে তার হালকা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে।
ঢাকা থেকে যখন কলকাতায় রওনা দিয়েছিলাম, তখন আমার বন্ধুর মাথা ছিল আমার কোলে। প্রকৃতির নির্মম পরিহাসে ঢাকায় ফিরলাম বন্ধুর কোলে মাথা রেখে, প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায়। আমার বাসা আত্মীয়স্বজনে ভরে গেল। দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী হরলিকসের কৌটা নিয়ে আমাকে দেখতে এল। দেখা গেল, হূদরোগ বিষয়ে সবারই টনটনে জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাও প্রচুর। দু-একটা নমুনা দিই।
আমার অফিসের কলিগ, হামিদের কথা খেয়াল আছে না তোমার? (হামিদ নামের কাউকে আমি চিনি না, তবুও মাথা নাড়লাম।) গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে টিভিতে বসে তৃতীয় মাত্রা দেখছে, হঠাৎ বুকে চিড়িক দিয়ে ব্যথা। বউকে বলল, ফরিদের মা, এক গ্লাস পানি দাও। ফরিদের মা পানি এনে দেখে সব শেষ। হামিদ মরে পড়ে আছে। এক মিনিটেই মামলা খতম।
কাসেম চাচার কথা মনে আছে তোমার? এই তো সেদিন মোবাইলে কথা বলছিলেন, হঠাৎ করে হাত থেকে মোবাইল ছুটে পড়ে গেল। হার্ট অ্যাটাক, জায়গায় ডেড।
সবচেয়ে ভয়াবহ গল্প শোনাল ফিরোজ। ফিরোজের মতে, হূদরোগ হচ্ছে নীরব ঘাতক। তার গল্পটাও সেই রকম। এক লোক মিরপুর সনি সিনেমা হলের সামনে থেকে রিকশা নিয়েছে মিরপুর ১০ নম্বর যাবে বলে। রাস্তা ফাঁকা ছিল, রিকশাওয়ালা একটানে ১০ মিনিটে ১০ নম্বর এসে পেছনে তাকিয়ে দেখে সিট ফাঁকা। কী বিষয়? রিকশা আরোহী হার্ট অ্যাটাক করে মরে রিকশা থেকে মাঝ রাস্তায় পড়ে গেছে, রিকশাওয়ালা টেরও পায়নি।
এসব গল্প শুনে আমার হার্টবিট ৪৬ থেকে কমে ৪২-এ নেমে এল। কেউ বলল, ডাক্তার দিয়ে কাজ হবে না, রসুন খাও। আদাও খেতে পারো। আদা, মরিচ, রসুন, পেঁয়াজ, জিরা, হলুদ, গরম মসলা সবকিছুর মধ্যে কোনো না কোনো গুণ আছে, এটা মনে রাখবা। আরেক কবিরাজ দুলাভাই বললেন, সবকিছু বাদ দিয়া কালিজিরা মধু খাও। কালিজিরা মধু খেলে চারটি জিনিস বৃদ্ধি পায়। হার্টবিট, টাক মাথার চুল, ক্ষুধা এবং …। চতুর্থ জিনিসটির নাম আমি বলতে চাইছি না।
যে যা-ই বলে, আমি বিপুল বিক্রমে সেটাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ি। রসুন খাই। রসুন খেয়ে হাসপাতালে গিয়ে ইসিজি করাই, দেখি হার্টবিট বাড়ল কি না। কালিজিরা মধু খাই, খেয়ে আবার ইসিজি। রসুন, কালিজিরা, মধু তিনটা মিশিয়ে আবার ইসিজি। এর মধ্যে ফিরোজ উপদেশ দেয়, রোজ দুই ঘণ্টা করে হরর সিনেমা দেখেন, হার্টবিট বাড়বে। হরর সিনেমার বদলে ক্রাইম ম্যাগাজিনও পড়তে পারেন, তবে ওটা বেশি রিস্কি। মাস খানেকের মধ্যেই আমি হরর সিনেমা দেখতে দেখতে হিচককের ভক্ত হয়ে গেলাম। আরেকজন বুদ্ধি দেয়, শেয়ারবাজারে ইনভেস্ট করেন, হার্টবিট না বাইড়া যাইব কই? বহু ঝামেলা করে বিও অ্যাকাউন্ট খুলে শেয়ারে নামলাম। দিনশেষে শেয়ারের দাম বাড়ে, হার্টবিট বাড়ে না। ওটা ৪৬ থেকে ৪৮-এর মধ্যে ওঠানামা করে। এর মধ্যেও ব্যাপার আছে। পুরুষ ডাক্তার ইসিজি করালে হার্টবিট হয় ৪৬, সিস্টার করালে একটু বেড়ে ৪৮। এটা আমার দোষ না ইসিজি মেশিনের দোষ—কিছুই বুঝি না।
ওষুধপত্র, আদা-রসুন, কালিজিরা মধু, হরর সিনেমা এবং শেয়ারবাজারের বদৌলতে দুই বছরে আমার হার্টবিট বেড়ে হলো ৫০।
১১ মার্চ ২০১১। বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ম্যাচ। বাংলাদেশ ৮ উইকেটে ১৭১। জয়ের জন্য দরকার ৫৫ রান। আমি হার্টের রোগী, কাজেই এমতাবস্থায় খেলা দেখা বাদ দিয়ে আমি ফেসবুকে বসলাম। একটু পরে হঠাৎ হইচইয়ের শব্দ পেয়ে ছুটে গেলাম টিভিরুমে। মাহমুদুল্লাহ একটা ৪ মেরেছে। আমার বুক ঢিপঢিপ করছে। মিতু বলল, তোমার কি খারাপ লাগছে? আমি কম্পিত কণ্ঠে বললাম, আমার হার্টবিটটা চেক করে দ্যাখো তো? মিতু মেপে বলল, ৫৮। এর মধ্যে শফিউল আরেকটি ৪ মেরে বসল। আমি বললাম, আবার মাপো, মিতু জানাল ৬০। এক বল পরেই মিতু—সরি, মিতু না—শফিউল ৬ মারল। মিতু আবার হার্টবিট মাপল। রান দরকার ৩৯, বল বাকি আছে ৪৮, হার্টবিট ৬৪। মাহমুদুল্লাহর আরেক রান, হার্টবিট ৬৫। পরপর তিনটা ডট বল, হার্টবিট নেমে এল ৬৩-তে। আবার এক রান, হার্টবিট ৬৪। ৪৪ ওভার শেষে ৮ উইকেটে ১৯২। বল বাকি ৩৬, রান দরকার ৩৪। রানরেট ৪.৩৬, রিকোয়ার্ড রান রেট ৫.৬৬, হার্টবিট ৬৪। ৪৬তম ওভারের দ্বিতীয় ও পঞ্চম বলে শফিউলের দুই-দুইটা ৪। হার্টবিট এক লাফে ৭০। ৪৮ ওভার শেষে মাত্র ৫ রান দরকার, বল আছে ১২, রানরেট ৪.৬, রিকোয়ার্ড রানরেট ২.৫, হার্টবিট ৮০।
এরপর একটা লেগ বাই, হার্টবিট ৮৪। পরের বলে কোনো রান নেই, উত্তেজনা চরমে, হার্টবিট ৮৮। পরের বলে এক রান। হার্টবিট ৯২। পরের বলে কোনো রান নেই, হার্টবিট ৯৮, সঙ্গে সামান্য শ্বাসকষ্ট। পরের বলও ডট, হার্টবিট ১৩০। পরের বলে মাহমুদুল্লাহ সপাটে ব্যাট চালালেন। আর মাপতে হলো না, বুকের ঢিপঢিপ শব্দ গুনে দেখলাম হার্টবিট আনুমানিক ২৬০, বল মাঠের বাইরে , চা-আ-আ-আ-র-র-র। আমি জ্ঞান হারালুম।
শেষকথা: স্বাভাবিকের চেয়ে কম হার্টরেট থাকলে সেটাকে বলে ব্র্যাডিকার্ডিয়া (Bradycardia)। এটা একটা অসুখ। আবার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হার্টরেটও আরেক ধরনের অসুখ। এর নাম টেকিকার্ডিয়া (Tachycardia)।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২১, ২০১১
Leave a Reply