রস+আলো: তো খেলা দেখার ২৪ ঘণ্টা পর আপনার অনুভূতি এখন কেমন?
দর্শক: এখন কিছুটা শান্ত। টেনশনে সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। ভোরের দিকে ঘুমিয়েছিলাম তো, মাথাটা একটু ভোঁ ভোঁ করছে। এ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করবেন না, তা হলে কিন্তু ২৪ ঘণ্টা আগে ফিরে যাব।
রআ: আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। ২৪ ঘণ্টার বদলে আপনি এক সপ্তাহ আগে ফিরে যেতে পারলে ভালো হতো।
দর্শক: আমরা তো গতকালই সেই রকম কিছু চেয়েছিলাম। আমরা কি ওদের কম ভালোবাসি। যখন ভালো খেলে কী করি না আমরা? নিজেদের সবকিছু দিয়ে ওদের জন্য রাস্তায় নেমে মিছিল করি।
রআ: জি, আমরা জানি। আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে জেতার পর আমরা সবাই তা-ই দেখেছি। কিন্তু খেলায় তো হারজিত থাকতেই পারে, তাই না?
দর্শক: অবশ্যই পারে। আমরা কি ওদের বলেছিলাম যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে জিততেই হবে? কিন্তু আমরা যেভাবে হেরেছি, এটা কি হারা বলে?
রআ: না না, তা ঠিক। এভাবে হারাটা মোটেও উচিত হয়নি। আসলে হারতে কে চায় বলেন? সাকিব-তামিমরাও নিশ্চয় চায়নি এভাবে হারুক। কিন্তু হয়ে গেছে। কিন্তু তার বদলে আমরা যা করেছি, তা কি ঠিক হয়েছে?
দর্শক: কেন ঠিক হবে না, অবশ্যই ঠিক হয়েছে।
রআ: আচ্ছা মেনে নিলাম ঠিক হয়েছে। ওরা খারাপ খেলেছে তাই মনের ক্ষোভ মিটিয়েছেন। ওদের পোস্টার ছিঁড়েছেন, আগুন দিয়েছেন। কিন্তু ওদের বাসে জুতা, ইট-পাথর ছুড়ে মারা, জাতীয় পতাকায় আগুন দিয়েছেন কেন? পতাকাটা কি আমাদের সবার না?
দর্শক: উত্তেজনা ধরে রাখতে পারিনি। আসলে তখন কী করছি মাথায় ছিল না।
রআ: এ অবস্থাকে ডাক্তারি ভাষায় কী বলে আপনার মনে হয়।
দর্শক: শোনেন, আপনি যদি এসব বলার জন্য আমাকে এখানে নিয়ে আসেন তা হলে কিন্তু ভালো হবে না।
রআ: আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের গাড়িতে ইট-পাটকেল কেন মেরেছেন? ওরা তো ভালোই খেলেছে।
দর্শক: ওরা আমাদের বিরুদ্ধে এত ভালো খেলতে গেল কেন?
রআ: তা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, ধরুন আপনার ছোট ভাই বা বোন পরীক্ষায় খারাপ করেছে বা একটা ভুল করেছে, আপনি কি তার গায়ে জুতা ছুড়ে মারবেন?
দর্শক: জানি না (রেগে গিয়ে)।
রআ: দেখুন রাগবেন না। রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। সেদিন সাকিবরা হেরেছে সামান্য একটা খেলায় কিন্তু আমরা দর্শকেরা পুরো দেশটাকে যে হারিয়ে দিয়েছি এটা বুঝতে পেরেছেন?
দর্শক: জানি না (আরও রেগে)।
রআ: ওদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে রাগ ঝাড়ার প্রয়োজনটা কি খুব বেশি ছিল?
দর্শক: বললাম না, তখন মাথা ঠিক ছিল না।
রআ: আমরা দর্শক ছিলাম, তাতেই যদি আমাদের এত খারাপ লাগে, তা হলে বোঝেন যারা খেলেছে তাদের কেমন লেগেছিল?
দর্শক: তিন উইকেট পড়ার পর ওরা সতর্ক হলো না কেন?
রআ: আমাদের দেশের খেলোয়াড়দের সঙ্গে আমাদের দেশের দর্শকদের পার্থক্য কী জানেন?
দর্শক: কী?
রআ: আমরা দর্শকেরা খেলাটা একটু বেশি বুঝি কিন্তু মাঠে গিয়ে খেলার যোগ্যতাটা আমাদের নেই।
দর্শক: আপনার এসব আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দিয়ে অন্য কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন। না হলে উঠলাম।
রআ: শেষ একটা কথা শুনে যান। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল শুধু একটা খেলায় হেরেছে। সামনে আরেক দিন ভালো করবে। অতীতেও হারিয়েছে অনেক দলকে। আমরা আসলেই অতীতের কথা কখনোই মনে রাখি না। কই, দেশে এত সমস্যা, এত দুর্নীতি, এত হত্যা-খুন, ছিনতাই, প্রতিদিন খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছে, পাতালে চলে গেছে শেয়ারবাজার—এসবের বিরুদ্ধে তো কখনো প্রতিবাদ করেননি। পরপর তিনবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও আমাদের বিবেক এতটুকু কেঁপে ওঠেনি। বড় বড় দুর্নীতিবাজ চোখের সামনে দিয়ে দামি গাড়ি হাঁকিয়ে চলে যায় আমরা নেতা নেতা বলে পেছন পেছন ছুটি। কখনো কি তাদের বাড়ির সামনে জমায়েত হয়ে প্রতিবাদ করেছি? এই ক্রিকেট দলই অতীতে আমাদের অনেকবার পুরো জাতিকে এক করে আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়েছে। আর, আমরা কত সহজে সেই আনন্দের দিনগুলোর কথা ভুলে গেছি। শুধু এই ভুলে যাওয়ার কারণে প্রতিবার নির্বাচনের আগে আমাদের সামনে মুলো ঝুলিয়ে ২০ বছর ধরে রাজনৈতিক দলগুলো দেশটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। যে দেশে বসবাস করে আমাদের একমাত্র গর্বের বিষয় ছিল ক্রিকেট, সেই ক্রিকেটারদের আমরা একটা খেলায় হারার জন্য ক্ষমা করতে পারিনি। সেই একমাত্র গর্বের গলায় আমরা জুতা পরিয়ে দিয়েছি। ক্রিকেটের এই হার যদি লজ্জাজনক হয়, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের সবার হারটাকে কী বলবেন?
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: তাওহিদ মিলটন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৭, ২০১১
Leave a Reply