একটি প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে গেছে এই ভালোবাসা দিবসটি। বিশেষ করে আমার মতো সিঙ্গুলার নম্বরের জন্য। আগে এই বদখত দিনটি ছিল না এ দেশে। ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ নিজেই একটা পাক্কা প্রেমিক। ধুরন্ধরও বটে কিছুটা। ঠিকই লক্ষ করেছে যে বাংলাদেশে পয়লা ফাল্গুন অর্থাৎ ১৩ ফেব্রুয়ারি বাসন্তী শাড়ি পরে একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছে ফুরফুরে মেজাজে। তাই আনলাকি থার্টিনকে ‘লাকি’ করতেই বোধ হয় ‘চালাকি’ করে পাশে বসে গেছে প্রেমিক সেজে। ১৩ আর ১৪। ফেঁসে গেছি আমরা প্রেমিকাহীন জাটকা ইলিশেরাও। আগে প্রেমিকদের এক পকেটে হাত ঢোকালেই চলত, এখন হাত দিতে হয় দুই পকেটে। আর সিঙ্গেল জাটকাদের আগে শুধু প্রথম ফাগুনের রংটা গিললেই চলত। এখন ভ্যালেন্টাইনের ঢংটাও গিলতে হয়। কাঁহাতক আর রংঢং? তাই এবার ঢংটা অন্তত গিলব না, প্ল্যান করলাম। প্ল্যানটা কী জানেন?
ধরব। ভালোবাসা ধরব!
দুই.
মানুষ মাছ ধরতে যায় সরোবরে। আমি গেলাম ভালোবাসা ধরতে ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে। ভালোবাসা দিবসে প্রচুর ভালোবাসা এসেছে অতিথি পাখির মতো। কখনো চোখে দুরবিন লাগিয়ে, কখনো গালে হাত দিয়ে বসে ভালোবাসা খুঁজছি। দেখি, চারদিকে প্রচুর ভালোবাসা। লেকের সিঁড়িতে ভালোবাসা, ডিঙিতে ভালোবাসা, ফাস্ট ফুডে ভালোবাসা, ড্রিংকসের স্ট্রতে ভালোবাসা। ফুটপাতে ভালোবাসা, ব্রিজের রেলিংয়ে ভালোবাসা। স্টেপ কাটে ভালোবাসা, লেয়ার কাটে ভালোবাসা।
আমি যে গাছের গোড়ার বেঞ্চে বসে ছিলাম, তার ডাল থেকে আমার মাথার ওপর দিয়ে ফ্লাইং সসারের মতো নামল দুটো উড়ন্ত ভালোবাসা! বু ফুঁ দিলাম। বাঁয়ে তাকালাম। দেখি, একটু দূরে আমার চোখে চোখ রেখে অপলক আমার দিকে তাকিয়ে আছে এক জর্জেট ভালোবাসা। একা। ভালোবেসেই কি না কে জানে—চোখে চোখ রেখে আমার দিকে ক্যাটওয়াক ছন্দে এগিয়ে আসতে লাগল জর্জেট! হাত দুটো ওর পেছনে। হার্টবিট বাহাত্তর থেকে সেঞ্চুরিতে পৌঁছল। সোজা এসে আমার গা ঘেঁষে বসল। আমি বড় বড় চোখে একটু সরে বসলাম। এবারে হাত পেছন থেকে সামনে নিয়ে এল জর্জেট। হাতে একটি উদ্যত গোলাপ! শাসানোর ভঙ্গিমায় বলে, ‘একদম নড়বে না। খবরদার।’
ভয়ংকরভাবে চমকে উঠি। বলি, ‘ল্যাংগুয়েজ, প্লিজ। আপনি করে বলুন!’ ‘চোপ! তুই করে বলিনি এটাই ভাগ্য!’ আরেকটু পেছনে সরে আসি। সরে এসেই চোখ বড় হয়ে যায় আমার। কার গায়ে যেন ধাক্কা খেলাম! দেখি একজন সুতি ভালোবাসা বসে! পিওর কটন। হাতে উদ্যত রজনীগন্ধা! মুখে কুটিল হাসি। সর্বনাশ, এবার বাঁয়ে সরে এসে মধ্যবর্তী হই। কিন্তু ওরা ক্রমশ কাছে ঘেঁষতে থাকে। LOVE স্যান্ডউইচ বানাবে বোধ হয়! আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলি, ‘আমি কিন্তু লোকজন ডেকে জড়ো করব!’
সুতি ফিসফিসিয়ে বলে, ‘লাভ নেই। ওই যে দেখ, চারদিকে আমাদের মেয়েরা বসে! একদম চুপ!’
সর্বনাশ! দেখি, পিলারের ওপর এক গোলাপি ভালোবাসার হাতে ভ্যালেন্টাইন কার্ড। একদৃষ্টে তাকিয়ে কার্ড নাচাচ্ছে। চটপটির চেয়ারে এক প্রিন্টেড ভালোবাসা। হাতে একটা বালিশাকৃতির লাল হূদয়। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে হূদয়টার ওপর মাথা রেখে। দেখি, একটা গাড়ির বনেটের ওপর একটি সাদা-কালো ভালোবাসা। এক হাতে একটা ফুলের তোড়া আর অন্য হাতে একটি ঝুনঝুনি! আমাকে দেখিয়ে ঝুনঝুনি নাচাচ্ছে—মারের ভঙ্গিমায়। ধক করে উঠল বুকটা! একটি হাত সন্তর্পণে আমার কোমর পেঁচিয়ে ধরেছে। দেখি জর্জেটের হাত! কাঁদো কাঁদো গলায় বলি, ‘আমি কিন্তু এবার চিৎকার করব।’ ফিসফিসিয়ে শাসায় জর্জেট, ‘চিৎকার করলে আমরাও করব। আমাদের পাওয়ার তোমার চাইতে বেশি।’
হাত সরিয়ে নেয় জর্জেট। কটনের দিকে তাকিয়ে হতাশায় মাথা নাড়ে। সুতি ভালোবাসা আমার শার্টের ওপরের একটি বোতাম খুলে রজনীগন্ধার স্টিক সেঁধিয়ে দেয়। ‘অ্যাই, প্লিজ, সুড়সুড়ি লাগছে। লজ্জাও লাগছে কিন্তু!’ ‘চোপ।’ ফিসফিসিয়ে ওঠে জর্জেট। ‘ছেলেমানুষের আবার সুড়সুড়ি বা লজ্জা কিসের? দেখ, ফারজানা, আরও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখ!’ আস্তে করে পেছন থেকে কে যেন আমার গলায় ঝোলানো দুরবিনটা তুলে নেয়। আর সঙ্গে সঙ্গে সুতি-জর্জেট দুজনই দাঁড়িয়ে যায়। দুজন একসঙ্গে বলে ওঠে, ‘স্লামালাইকুম, ম্যাডাম।’ চট করে দাঁড়িয়ে যায়। দেখি, আমার দুরবিন হাতে একজন ইউনিফর্ম ভালোবাসা দাঁড়িয়ে। আর কখন যেন গোলাপি ভালোবাসা, প্রিন্টেড ভালোবাসারা ইউনিফর্মের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
ইউনিফর্ম: কিছু পেলে?
জর্জেট: নো আর্মস, ম্যাডাম।
শুধু এটা পেয়েছি পকেটে।
সর্বনাশ! আমার ভিজিটিং কার্ড হোল্ডারটা জানি কখন হাতিয়ে নিয়েছে কটন। বোধ হয় সুড়সুড়ি দিয়ে। হোল্ডারটা খুলে একটা কার্ড নিয়ে পড়তে থাকে ইউনিফর্ম ভালোবাসা। আর পড়েই চক্ষু চড়কগাছ। বিগলিতভাবে বলে, ‘ইয়ে, আ-প-নি? এখানে কী করছেন একা একা?’
আমি: আমার তো দোকা নেই, একা-দোকা বুঝি না।
গোলাপি: ম্যাডামও তো একা। তাই বলে উনি কি একা বসে আছেন?
রাগী চোখে তাকান ইউনিফর্ম গোলাপির দিকে।
ইউনিফর্ম: আহ্, লিপি! কাউকে না চিনে ফস করে কিছু বলবে না। ইয়ে—
আমি: বলুন।
ইউনিফর্ম: আসলে দূর থেকে আপনাকে দেখে আমার কাছে একজন ‘ইভ টিজার’ মনে হয়েছিল। তাই এদের পাঠিয়েছিলাম, স্যরি।
আমি: নো নো, ইটস ওকে। ইউনিফর্ম: থ্যাংক্যু। দুরবিন দিয়ে কী করছেন?
আমি: আসলে, পাখি পর্যবেক্ষকদের মতো আমিও একজন ভালোবাসা পর্যবেক্ষক। দুরবিন দিয়ে ভালোবাসা খুঁজছি।
ইউনিফর্ম প্রিন্টেড ভালোবাসা থেকে লাল হূদয়টা নিয়ে আমাকে দিয়ে বলেন, ‘আমরা লজ্জিত। কাল থানায় এসে এক কাপ চা খেয়ে যাবেন, প্লিজ।’
উধাও হয়ে যায় ভালোবাসার দল।
আমি মাথা নিচু করে ভাবতে থাকি—ভালোবাসা দিবসের পরের দিনের এই চা-টা কি হবে LUCKY চা, নাকি
চা-LUCKY?
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১১
Leave a Reply