তিতলির সঙ্গে আমার পরিচয় বুয়েটে ভর্তিপরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার পর, যখন মেডিকেল টেস্ট হয়, তখন। আমার বড় ভাইও বুয়েটে পড়তেন। তিনি আমাকে বলে রেখেছিলেন, স্বাস্থ্যপরীক্ষার সময় পরনের কাপড় নিঃশেষে খুলে ফেলতে হবে, লজ্জা পেলে চলবে না। আমার রোল ছিল আনলাকি থার্টিন, তিতলির রোল ছিল চৌদ্দ, কাজেই আমরা দুজন একই সঙ্গে স্বাস্থ্যপরীক্ষা দিতে বুয়েটের মেডিকেল সেন্টারে গিয়েছিলাম। ওই রুমে মেয়ে বলতে একা তিতলিই ছিল, আর আমি এসেছি স্ত্রীবর্জিত পৃথিবী থেকে, কাজেই ওই ঘরে অন্য ছেলেদের উপস্থিতি সত্ত্বেও আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। স্বাস্থ্য পরীক্ষকদের মধ্যে কোনো মহিলা ছিলেন না। তিতলি সহজেই পার পেয়ে যাবে, অথচ আমাকে জন্মমুহূর্তের পোশাক একটু পরই ধারণ করতে হবে, এই চিন্তা দিয়ে আমি শ্বাস-প্রশ্বাস বজায় রাখছিলাম।
পরে আমরা, আমি আর তিতলি, সেশনালে একই গ্রুপে পড়লাম। সেশনাল জিনিসটা হলো প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস—ফার্স্ট ইয়ারে লোহার কাজ, কাঠের কাজ ইত্যাদি আমাদের একসঙ্গে করতে হয়েছিল।
মফস্বল শহর থেকে এসেছি, আর তিতলি এসেছে হলিক্রস থেকে, খুবই স্মার্ট ছিল, আর আমার পুরুষময় জগতে তিতলিই ছিল একমাত্র নারী। আর আমাকে তখন কবিতায় পেয়ে বসেছে। আমি তিতলির বেণির নিচের গ্রীবার দিকে তাকিয়ে ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসে কবিতা লিখতাম। ও ফার্স্ট বেঞ্চে বসে তরুণ শিক্ষকদের কথা হাঁ করে গিলত ও নোট নিত।
একদিন আমি ওকে বললাম, তিতলি, তোমার চোতাটা দিয়ো।
ও বলল, চোতা কী?
আমি বললাম, বুয়েটে পড়ো, চোতা কী চেনো না? চোতা মানে হলো নোটস। আমি ক্লাসে নোট নিই না। তোমার চোতাগুলো আমার লাগবে। তুমি আমাকে ধার দেবে, আমি ফটোকপি করে ফেরত দেব।
তিতলি বলল, নোট নাওনি, কী করেছ?
আমি বললাম, কবিতা লিখেছি।
দেখি, কী লিখেছ?
না না, তোমাকে দেখানো যাবে না।
আচ্ছা, দেখব না। আর শোনো, এসব চোতা-টোতা পড়বা না তো! সব সময় মূল বই পড়বা। নাইলে মূর্খই থেকে যাবা।
আমি সঙ্গে সঙ্গে রফিক আজাদের কবিতা শুনিয়ে দিলাম,
বালক জানে না তো কতটা পথ গেলে,
ফেরার পথ আর থাকে না কোনো কালে…
বালক ভুল করে নেমেছে ভুল জলে,
বালক ভুল করে পড়েছে ভুল বই,
পড়েনি ব্যাকরণ পড়েনি মূল বই।
কিন্তু আমাদের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের এক ফাঁকে সে আমার ক্লাসনোট খুলে কবিতাটা পড়ে নিয়েছিল।
কবিতাটা ছিল এ রকম:
চারদিকে রিকশা গাড়ি, নেই কোনো বেহুলা ভাসান,
আমাকে দুদণ্ড কষ্ট দিয়েছিল, বুয়েটের শায়লা হাসান।
(বলা বাহুল্য, শায়লা হাসান তিতলির ভালো নাম)
তিতলি বলল, শিবলি, তুই আমাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিস কেন? তুই কি আমার প্রেমে পড়েছিস?
আমি বললাম, না, পড়ি নাই, কিন্তু আমার কবিতার জন্য আমার প্রেমিকার প্রক্সি তোকে দিতে হচ্ছে। তুই মাইন্ড করিস না।
তিতলি বলল, আমি খুবই মাইন্ড করেছি। ফ্রেন্ড হলো ফ্রেন্ড। ফ্রেন্ডের সাথে যারা প্রেম করতে চায় তারা হলো খ্যাত্। আর কোনো দিন এই সব তুই বলবি না, বুঝেছিস।
একদিন আমি তিতলিকে বলেই ফেললাম, তিতলি শোন, আমার না আর তোর প্রক্সি রোলটা ভালো লাগছে না। তুই আমার জেনুইন হবি?
ও বলল, ধেৎ, কী বলিস!
আমি বললাম, আচ্ছা, তুই একটা কিছু বল। না হয় ‘না’ই বলে দে।
না না, এই সব হবে না। ক্লাসমেটের সঙ্গে কেউ প্রেম করে না।
আমার জন্মদিনে তিতলি একটা কবিতার বই (নির্মলেন্দু গুণের চৈত্রের ভালোবাসা) আরেকটা মূল বই (অ্যানালাইটিক্যাল মেকানিক্স বাই রবিনসন) উপহার দিয়েছিল।
কিন্তু তিতলি কোনো দিনও আমার প্রোপোজালে সাড়া দেয়নি। অচিরেই বুয়েটের একজন শিক্ষকের সঙ্গে তার বিয়ে হয় এবং তারা অস্ট্রেলিয়া চলে যায়।
তারপর ২৫ বছর কেটে গেছে। এ বছর, বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত পুনর্মিলনীতে হঠাৎ দেখি তিতলি। কী আশ্চর্য, তিতলি সেই ২৩-এই রয়ে গেছে। একদম বড় হয়নি। ঘটনা কী। আমি তার পেছনে গিয়ে তার মাথায় টোকা মেরে বললাম, এই, আমাকে চিনতে পেরেছ?
উত্তর এল, হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। আপনি শিবলি আংকেল। মা-র অ্যালবামে আপনার ছবি দেখেছি।
একটু ভড়কে গেলাম। তিতলির দেখা পেলাম সঙ্গে সঙ্গেই। সে ভীষণ বুড়িয়ে গেছে, গালে মেছতার দাগ। খুব হতোদ্যম হলাম। ‘আমার মেয়েটার সঙ্গে তোমার ভাব হয়ে গেছে নাকি? পুণ্যি, আংকেলকে সালাম দিয়েছ?’ পুণ্যির মা তিতলি বলল।
সারাটা দিন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে হইহল্লা করে ভালোই কাটল।
একটা ফাঁকে, বুয়েটের ক্যাফেটেরিয়ায় চায়ের পেয়ালা সামনে রেখে তিতলি বলল, আচ্ছা শিবলি, তুমি বিয়ে করোনি কেন?
আমি বললাম, এত দিন পরে সেই প্রশ্ন করে লাভ আছে? আজ হায় রুবি রায় ডেকে বলো আমাকে তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি!
মানে কী?
আমি একটা মেয়েকে বুয়েটে পড়ার সময় প্রপোজ করেছিলাম। মেয়েটা কোনো রিপ্লাই দেয়নি। ইন ফ্যাক্ট, মেয়েটা রিজেক্ট করেছিল। বাদ দাও। কে হায় হূদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?
মেয়েটা তোমাকে রিপ্লাই দেয়নি মানে! তোমার বার্থডেতে মেয়েটা একটা পাতলা কবিতার বই, আরেকটা মোটা অ্যানালাইটিক্যাল মেকানিক্স বই দিয়েছিল। তোমার মনে আছে?
আছে।
ওই মোটা বইটার ভেতরে একটা চিঠি ছিল, সেটা পড়েছিলে?
হায় হায়! আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম। কবিতার বইটা পেয়ে সেটা নিয়েই মত্ত ছিলাম। আর পরীক্ষা পাসের জন্য সহায় ছিল চোতা। বললাম, ওই মোটা মেকানিক্স বইটা তো কোনো দিনও খুলে দেখিনি। কী ছিল সেটাতে?
আমি বলি, তিতলি বলো, প্লিজ বলো, ওটাতে কী ছিল…
এত দিন পরে আর সেটা বলে লাভ কী। আম্মা-আব্বা কোনো দিনও চাননি আমি দেশ ছাড়ি। তুমি যদি সেদিন ওই বইটা একবারও খুলতে!
রায়হান স্যার, মানে তিতলির স্বামী, তাদের মেয়ে পুণ্যিকে নিয়ে এদিকে আসছেন। ভাগ্যিস মাথা তুলে দেখে নিয়েছিলাম। না হলে এখনই আমি তিতলির হাত ধরে ফেলতাম। বলতাম, তিতলি বলো, ওই চিঠিতে কী ছিল। বলো… বলো…
বুয়েটের বর্তমান শিক্ষার্থীরা আমাকে ধরল, তাদের উপদেশ দিতে হবে। বললাম, শোনো, চোতা পোড়ো না, মূল বই পোড়ো। তা না হলে জীবনে কিছুই পাবে না।
(ওয়েবসাইটে পাওয়া কৌতুক অবলম্বনে)
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১১
Leave a Reply