এক তরুণ সহকর্মী আমাকে আচমকা জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, ভালো বাসা বলতে আপনি কী বোঝেন? এর অর্থ কী?’
‘কেন, এত বোঝাবুঝির কী আছে?’ আমার না-চমকা উত্তর। ‘ভালো বাসা হচ্ছে কম ভাড়ার ভদ্রপাড়ার উত্তম বাসা, আলো-বাতাস ঠাসা; যার শোবার ঘর থেকে উল্টো দিকের ফ্ল্যাটের জানালায় ঝোলানো কালিঝুলি ন্যাকড়া আর রন্ধনরত বুয়া অথবা তার ক্রন্দনরত পুয়াকে দেখতে হয় না।’
‘আহ-হা, স্যার’, অধৈর্য স্বরে সে বলল, ‘এ ভালো বাসা সে ভালোবাসা না, আমার জিজ্ঞাসা প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে। ওই ভালোবাসার অর্থ কী, স্যার?’
আমি বুঝলাম, প্রেম যদি মানুষকে অধৈর্য করে, প্রেম বিষয়ে জ্ঞান বিনিময়েও তাকে সমান ধৈর্যহারা করে। আমি স্থৈর্য বজায় রেখে বললাম, ‘অর্থটা তো তুমিই বলে দিলে।’
এবার তার কপালে কুঞ্চন দেখা দিল। অর্থাৎ ব্যাপারটা তার মগজ-গোচর হয়নি। ‘ভালোবাসার অর্থ হচ্ছে অর্থ’, আমি বললাম, ‘অর্থাৎ টাকা-কড়ি, মানি অ্যান্ড প্রোপার্টি।’
‘সেকি কথা, স্যার?’ সে অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘প্রেমের শাশ্বত আবেদনকে আপনি এভাবে অবনমন করবেন?’
আমি বললাম, ‘শোনো। এক মেয়েকে তার প্রেমিক প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, “তোমার বাবার টাকা-পয়সা কী রকম?” মেয়েটি একদিন বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমরা পুরুষেরা সব এক। আমার বাবাও তোমার সম্পর্কে এই একই প্রশ্ন করেন।” বাবাদের জামাই-বিচারে বড় কামাই থাকে এক নম্বরে। বাকি সব অনেক দূরের দুই নম্বরে।’
হ্যাঁ, তরুণ সহকর্মীরও এ রকম অভিজ্ঞতা আছে। তার এক বন্ধুর জন্য পাত্র খুঁজতে নেমেছেন বন্ধুর বাবা। এক সুপাত্রের খবর পেলেন, কিন্তু পাত্র দেখতে যেতে হবে ব্যাংকে। তিনি গেলেন, ঢোকার মুখে দেখলেন টাকাভর্তি ব্রিফকেস হাতে পাত্রও ঢুকছে, পেছনে দুই বন্দুকধারী গার্ড। প্রথম দর্শনেই পাত্রপ্রেম। এত টাকা! বাব্বা! গার্ড নিয়ে ঘুরতে হয়। ভদ্রলোক দেন অ্যান্ড দেয়ারই প্রস্তাব দিয়ে বসবেন, কিন্তু মাঝখানে ম্যানেজার যে তথ্য শেয়ার করলেন, তাতে মুহূর্তে সুপাত্র পরিণত হলো কুপাত্রে। পাত্রটি ব্যাংকের কেরানি। গার্ড নিয়ে নগদ টাকা আনতে গিয়েছিল। ‘কিন্তু, স্যার’, গল্প বলা শেষ করে সে বলল, ‘একটা-দুটা ব্যতিক্রমে কি আর নিয়মটা ভেঙে যায়?’
‘নিয়মটা কী রকম?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘নিয়মটা হলো গিয়ে স্যার…এই ধরুন লায়লা-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট।’
‘অর্থাৎ অমর প্রেম? ভ্রমর কইও গিয়া? চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত?’
‘জি, স্যার। যেমন দেখা যায় আমাগো সিনেমায়।’
আমার মনে পড়ল, স্কুল পালিয়ে উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখতাম। কঠিন প্রেমময় সব সিনেমা। পাড়ার যমুনাদিও দেখতেন। এবং বাড়ি ফেরার পথে রিকশায় বসে প্রেমের প্রলম্বিত বিলম্বিত অভিঘাতে চোখের পানিতে রুমাল ভেজাতেন। অনেক অনেক বছর পর এক বিশ্ব ভালোবাসা (বিভা) দিবসে সেই যমুনাদির ছেলে বরুণ তার প্রেমিকাকে হাজির করেছে মাকে প্রণাম করাতে, সঙ্গে দুই সহপাঠিনী নিয়ে। রহস্য করে মাকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘আচ্ছা মা, বলো তো, পুষ্পিতা এই তিনজনের কোন জন?’ যমুনাদি এক মুহূর্ত না ভেবেই আঙুল তুলে দেখিয়েছেন পুষ্পিতাকে। তাজ্জব বরুণ একগাল হেসে জিজ্ঞেস করেছে, ‘কী করে বুঝলে, মা?’ যমুনাদি বলেছেন, ‘এই তিন মেয়ের মধ্যে এটিকেই আমার সবচেয়ে অপছন্দ হয়েছে কি না, সে কারণে।’
যমুনাদি অনেক রাত উত্তমকে চোখে লেপে ঘুমাতে যেতেন নিশ্চয়। আর কোনো সিনেমায় যদি উত্তমের মা এ রকম বলতেন সুচিত্রাকে দেখে, কী প্রতিক্রিয়া হতো যমুনাদির?
সহকর্মীটি একটি দৈনিকে বিভা দিবসের প্রতিযোগিতায় ‘ভালোবাসার অর্থ কী?’ এই প্রশ্নের একটি চটকদার উত্তর আমার কাছ থেকে আদায় করে পাঠিয়ে দিয়ে একটা পুরস্কার বাগানোর মতলবে আছে। আমার কথাবার্তায় সে জন্য সে খুব প্রীত হচ্ছে না। একটু বিরক্তি নিয়েই সে বলল, ‘ভালোবাসা কি তাহলে স্যার এ-ই?’
‘তা কেন হবে!’ আমি বললাম, ‘ভালোবেসে মানুষ তাজমহল বানিয়েছে না! ভালো বাসতে বাসতে দেবদাস মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে না!’
দেবদাসের কথায় সে প্রীত হলো। শাহরুখ খানের দেবদাস-মৃত্যু তাকে এখনো কাঁদায়, সে জানাল। তাজমহলের প্রসঙ্গটাও তার মনে ধরল। স্ত্রীর জন্য কালের কপোলতলে এমন এক বিলাসী নয়নজলের ফোঁটা, আহা!
‘শাহজাহানের স্ত্রীর চেহারাটা নিশ্চয় দারুণ জটিল ছিল, স্যার,’ সে জানতে চাইল।
‘জটিল?’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
‘জটিল মানে সুন্দর। মানে জোস্।’
‘ও। তা হতে পারে। তবে মমতাজ ছাড়াও শাহজাহান সাহেবের আরও বিবি ছিলেন বলে শুনেছি। সত্য-মিথ্যা জানি না।’
‘তার পরও, স্যার, এমন হেব্বি একটা সৌধ বানাইলেন প্রেমের খাতিরে, তার জানেজিগারের জন্য।’
‘বটে। তবে হেব্বি সৌধ বানানোর জন্য হেব্বি পয়সাও ছিল সম্রাটের।’ সহকর্মীর চোখ থেকে আলো কিছু কমে গেল। ‘আবারও টাকা-পয়সা, স্যার? অর্থ? প্রেমের অর্থ, প্রেমের জন্য অর্থ? তাহলে তো স্যার টাকা-পয়সাটাই আসল।’
‘ঠিক তা-ও না’, আমি বললাম, ‘অর্থের সঙ্গে স্বার্থও আছে। ভালোবাসা এক ধরনের স্বার্থপরতাও। একটু নান্দনিক, তাতেই রক্ষা। ভালো হয়, যদি সেই নান্দনিকতাটা রঙ্গে-রসে টইটম্বুর থাকে।’
‘কথাগুলো একটু কুটিল হয়ে যাচ্ছে না, স্যার? মানে ঝাপসা?’
সহকর্মী যে প্রতিযোগিতায় নামছে, তাতে প্রেম-সম্পর্কিত দুই লাইনের একটা উপদেশের ব্যাপারও আছে। কাতর হয়ে সে তাই জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, বিভা দিবসে কি আপনার কোনো উপদেশ নেই তরুণদের জন্য?’
‘উপদেশ দেওয়ার আমি কে?’ আমি বললাম, ‘উপদেশ তো দিয়েছেন কুমিল্লার সেই কল্পনা খালা, যিনি আমাদের বাড়িতে এসে লাক্স সাবানের ওই গানটার সঙ্গে আরেকটা গাইতেন। সেটি এই:
চুন বেশি খাইলে মুখ পুইড়া যায়, কম খাইলে বুক জ্বলে, প্রেম কইর না দুইজনের মন সমান না হইলে।’
সহকর্মী দ্রুত গানটি লিখে নিল। তার কাছে এটি হিট। আর্চিস আর হলমার্কের সুদিন আর নেই। এখন ছাপা কার্ডের জায়গা নিয়েছে ভার্চুয়াল কার্ড, ই-কার্ড। আমি নিশ্চিত, এই দুই লাইন এখন হাইজ্যাক হয়ে যাবে। বিভা দিবসের ই-কার্ডে প্ল্যাকার্ড হবে।
তা হোক। অন্তত দুই জোড়া বিভা দিবসীকেও যদি এই উপদেশ বাঁচাতে পারে, তাহলে কল্পনা খালা তাঁর কবরে শুয়ে শান্তি পাবেন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১১
Leave a Reply