দিন ৭৫২
আমার অত্যাচারীরা আমাকে বরাবরের মতোই উত্ত্যক্ত করে চলেছে। দড়ি বা সুতোর ডগায় একটা কিছু বেঁধে আমার নাকের সামনে দোলাতে থাকে! আমার সহ্যশক্তিরও একটা সীমা আছে!
তারা নিজেরা গপগপ করে মাংস গেলে আর আমার বরাতে জোটে ট্যাবলেটের মতো শুকনো কী সব! খিদের ঠ্যালায় ওসবই খেতে হয়। তবে কোনো একদিন নিশ্চয়ই পালিয়ে যেতে পারব—এই স্বপ্ন দেখি আর সহ্য করে যাই এসব অনাচার।
তৃপ্তিদায়ক ব্যাপার অবশ্য একটা আছে। বাড়ির কোনো আসবাবের একটা অংশ খামচে বা কামড়ে নষ্ট করে ফেলতে পারলে প্রভূত আনন্দ লাভ করা যায়। আগামীকাল টবের একটা গাছ খেয়ে ফেলব। যত বিস্বাদই হোক!
দিন ৭৬১
উদ্যোগটা ব্যর্থ হয়ে গেল। অত্যাচারীদের একজন হাঁটছিল যখন, তার দুই পায়ের মাঝখানে ঢুকে পড়ছিলাম বারবার। একবার পড়ে যেতে যেতেও সামলে নিয়েছে। সে যখন সিঁড়ি বেয়ে নামবে, তখন আরেকবার প্রয়োগ করে দেখব এই পদ্ধতি।
অত্যাচারীদের বিবমিষা জাগাতে নিজেই বমি করে দিলাম আর্ম চেয়ারের ওপর। প্রত্যাশিত ফল পাওয়া গেল না। কাল তাদের বিছানার ওপর বমি করব। দেখি, লাভ হয় কি না।
দিন ৭৬৩
সারাটা দিন ঘুমোলাম রাতে তাদের ঘুমের চোদ্দটা বাজাতে। সারা রাত ম্যাও ম্যাও করব, খাবার চাইব।
দিন ৭৬৫
ইঁদুর ধরে ফেললাম একটা। ধরে ধড় থেকে মাথা আলাদা করে নিলাম। তারপর ইঁদুরের মাথাহীন শরীরটা টেনে নিয়ে গেলাম অত্যাচারীদের দেখাতে: ‘দেখো! আমি কতটা ভয়ংকর হতে পারি।’ ভেবেছিলাম, ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠবে তারা। কিসের কী! বরং আমাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে বলতে থাকল, ‘কী দারুণ বিড়াল আমাদের!’… হুমম! জলে গেল সমস্ত পরিকল্পনা।
দিন ৭৬৮
আমার অত্যাচারীদের ফ্যাসিবাদী চরিত্র নগ্নভাবে প্রকাশিত হলো আরও একবার। স্পষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে ‘গোসল’ নামের এক ভয়াবহ শাস্তি-প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হলো (নাৎসিদের ক্যাম্পে কি এভাবে অত্যাচার করা হতো?)। আর শুধুই কি গোসল, ‘শ্যাম্পু’ নামের কী এক রাসায়নিক তরল পদার্থও প্রয়োগ করা হলো তাতে! কেবল বিকৃত রুচি ও অসুস্থ মস্তিষ্কের কারও পক্ষেই এমন তরল পদার্থ আবিষ্কার করা সম্ভব।
একমাত্র সান্ত্বনা—এক অত্যাচারীর বুড়ো আঙুলের এক টুকরো মাংস, যা এখনো আমার দাঁতের ফাঁকে আটকে আছে।
দিন ৭৭১
আজ আমাকে একাকী এক ঘরে আটক রেখে পাশের ঘরে কী সব হইচই চলল। বাইরের লোকও ছিল জনা কয়েক। এখান থেকেই আমি বিদঘুটে গন্ধ পেলাম। নিশ্চয়ই তারা গিলছে একধরনের পানীয়, যাকে তারা বিয়ার বলে! কান পেতে আমি তাদের কথাবার্তাও শুনলাম এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য এল আমার কানে: আমাকে এখানে বন্দী করে রাখার কারণ—উপস্থিত এক অতিথির ‘অ্যালার্জি’ আছে বিড়ালে। অ্যালার্জি ব্যাপারটা কী, জানতে হবে এবং সুযোগ বুঝে সেটার প্রয়োগ করতে হবে।
দিন ৭৭৪
এই অত্যাচারীদের কিছু কার্যকলাপ দেখলে পিত্তি জ্বলে যায়! এই যেমন, আমার ভাষার ভ-ও জানে না, তবু আমার সঙ্গে কথা বলার কী আকুল চেষ্টা! কী সব শব্দ করে মুখ দিয়ে এবং নিশ্চয়ই ভাবতে থাকে, আমি তাদের কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছি! গর্দভের দল! মাঝে-মাঝে অবশ্য আমার ভাষায় ম্যাও-ম্যাও করার চেষ্টাও করে। তবে উচ্চারণের যা ছিরি! হাসি চেপে রাখা দুষ্কর হয়ে পড়ে। ওদের এতই যখন শখ, তাই ভাবছি, ওদের জন্যই বিড়ালীয় ভাষাশিক্ষা কোর্স খুলব। প্রচুর পরিমাণে মাছ, মাংস আর দুধের বিনিময়ে পড়াব। তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করব কীভাবে, তা নিয়ে পরে ভাবা যাবে।
দিন ৭৭৮
আমি ছাড়া এই বাড়িতে আরও দুটো বন্দী আছে। দুটোই বোকার হদ্দ এবং চাটুকার। কুকুরটার কথাই ধরা যাক। তাকে মাঝেমধ্যেই ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হয় এবং সবচেয়ে অবাক কাণ্ড এই যে সে নিজে খুশিমনে বাসায় ফিরে আসে, অত্যাচারীদের হাত-পা চেটে আনন্দ প্রকাশ করে! দেখে ঘেন্না ধরে যায়। এত গবেট কেউ হয়!
আর ওই যে পাখিটা, ওটা তো পুরোদস্তুর স্পাই! সে অত্যাচারীদের কদাকার ভাষা শিখে নিয়েছে এবং প্রায়ই দেখি আলাপ করে তাদের সঙ্গে! আমি নিশ্চিত, আমার সমস্ত গতিবিধি ও কাজকর্মের বিশদ রিপোর্ট সে দেয় আমার শত্রুদের কাছে। চালিয়ে যাক সে! সময় আমারও আসবে। এই মুহূর্তে সে খাঁচার ভেতরে বলে নিরাপদে আছে। ব্যাপার না। আমি অপেক্ষায় থাকব।
ভাষান্তর: মাসুদ মাহমুদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ৩১, ২০১০
Leave a Reply