টেলিফোনের দোকানটি রাস্তার পাশেই। দোকানে যিনি বসে আছেন তিনি মধ্যবয়স্ক। যত্ন করে কলপ করলেও জুলফির দিকে বেশ কিছু পাকা চুল কাশফুলের মতো ঝুলে আছে। মূলত দোকানটি চালায় তাঁর ভাইপো ফয়সাল। চার দিন হয় সে টাইফয়েডে বিছানায় পড়ে আছে। তাই ভাইপোর অনুরোধে সকালে দোকানে এসে বসেছেন তিনি। মোবাইল ফোনের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় দোকানে এখন আর কেউ তেমন ফোন করতে আসে না। আসে সবাই মোবাইলে টাকা ভরাতে।
কয়েকজন কাস্টমার বিদেয় করে দিয়ে তিনি সবে পত্রিকাটি মুখের সামনে ঝুলিয়ে উপসম্পাদকীয় পাতায় ছাপা হওয়া ‘সামষ্টিক অর্থনীতি ও আমাদের বোরো ধানের ভবিষ্যৎ’ শিরোনামের নিবন্ধটি পড়তে শুরু করেছেন, তখনই দোকানের স্লাইডিং ডোরটা আস্তে করে খুলে গেল। উঁকি দিল গোলগাল সুন্দর এক কিশোরীর মুখ। দরজায় দাঁড়িয়েই সে জিজ্ঞেস করল, ‘টিঅ্যান্ডটি ফোন আছে?’
‘আছে’ বলে ফোনটি একটু এগিয়ে দিলেন ফয়সালের চাচা। মেয়েটির ওপর এক নজর চোখ বোলালেন। বয়স ১৮ কি ১৯। জামাকাপড় দেখে মনে হচ্ছে গার্মেন্টসে কাজ করে। তবে হাতে একটা বেশ সুন্দর ঘড়ি। গার্মেন্টসের মেয়েদের হাতে এমন ঘড়ি খুবই বেমানান। মেয়েটি ডায়াল করা শুরু করেছে। ‘হ্যালো’ বলতেই ফয়সালের চাচা কান খাড়া রেখে পত্রিকাটি আবার চোখের সামনে ঝুলিয়ে দিলেন।
মেয়ে: হ্যালো, এটা কি লোপা ম্যাডামের বাসা?
মহিলা: (অপর প্রান্তে) হ্যাঁ। বলছি।
মেয়ে: ম্যাডাম, স্লামালিকুম। আমি শুনলাম আপনার নাকি একজন কাজের মেয়ে লাগবে, যে আপনার বাচ্চার দেখাশোনা করবে। আমাদের বস্তির একজন আপনার নম্বরটা আমাকে দিল।
মহিলা: না, আসলে দরকার ছিল। কিন্তু আমি তো একজন মেয়েকে পেয়ে গেছি।
মেয়ে: ম্যাডাম, প্লিজ, আমার একটা কাজ খুব দরকার। ওই মেয়েকে যে টাকা দেন আমাকে তার অর্ধেক দিলেও হবে।
মহিলা: না, আমি যাকে পেয়েছি সে তো খুব ভালো। আমি অফিসে চলে গেলেও কোনো টেনশন করতে হয় না বাচ্চাকে নিয়ে। সে তো খুবই ভালো মেয়ে। তাকে ছাড়াই কীভাবে?
মেয়ে: (আরও করুণ কণ্ঠে) ম্যাডাম, আমাকে কাজটা দিলে ওই বেতনেই আপনার বাচ্চা দেখার পাশাপাশি আমি ঘরটাও মুছে দেব, সিঁড়িগুলো ঝাড়ু দিয়ে দেব, ফুলের টবে পানি দিয়ে দেব। আপনি যা যা বলবেন, তাই তাই করে দেব।
মহিলা: না, আমার লাগবে না। ওই মেয়েকে আমি ছাড়াব না। তুমি অন্য কোথাও দেখো।
বলে খট করে ফোন নামিয়ে রাখলেন তিনি।
এদিকে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে ক্রেডলে রিসিভার নামিয়ে রাখল মেয়েটি। ফয়সালের চাচা মুখের সামনে থেকে পত্রিকাটি নামিয়ে মেয়েটির দিকে করুণ চোখে তাকালেন। তাঁর মন খুব খারাপ হয়ে আছে। আহা রে, এত সুন্দর ঝকঝকে একটা মেয়ে। এই বয়সে কোথায় তার স্কুল-কলেজে যাওয়ার কথা, কিন্তু কাজের জন্য কী কাকুতি-মিনতিটাই না করল! মহিলা তাকে নিলই না।
ফয়সালের চাচা: এই মেয়ে, তোমার নাম কী?
মেয়ে: রাহেলা।
চাচা: খুব সুন্দর নাম। তোমাকে দেখে তো মনেই হয় না যে তুমি মানুষের বাসায় কাজ করো। পড়াশোনা করেছ?
মেয়ে: ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি। পরে আর পড়তে পারি নাই।
চাচা: তোমার জন্য খুবই খারাপ লাগছে। আচ্ছা, আমার বড় বোনের বাসায় একজন বাচ্চা দেখার জন্য মেয়ে খুঁজছিল। তুমি চাইলে আমি তোমাকে আমার বড় বোনের বাসায় কাজ দিতে পারি। আমাকে কয়েক দিন আগে বলছিল। ফোন নম্বর আছে। তুমি নিজেই কথা বলতে পারো।
মেয়ে: না, থ্যাংক ইউ, চাচা; লাগবে না আমার।
চাচা: কিন্তু একটু আগেই না বললা যে তোমার খুব দরকার! তুমি তো আর একটু হইলে ওই কাজের জন্য কেঁদেই দিতে।
মেয়ে: না, চাচা, আমার আসলে কাজের দরকার নাই। আমি আমার পারফরম্যান্স দেখতেছিলাম। আমি লোপা ম্যাডামের বাসাতেই কাজে ঢুকছি এক সপ্তাহ হয়। উনি আমার কাজে খুশি কি না সেটা যাচাই করলাম খালি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ৩১, ২০১০
Leave a Reply