লাখো বঙ্গজনতাকে বিশ্বকাপ টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়াতে দেখার পর লিখেছেন রাজীব হাসান
পুলিশ লাইন হাসপাতালে জন্ম হয়েছিল তাঁর। নবজাতককে দেখতে লাইন ধরে ভিড় করেছিলেন মামা-খালা-ফুফুরা। মনে আছে, তিনি প্রথম হাঁটতে শিখেছিলেন রেলিংয়ের লাইন ধরে। স্কুলে ভর্তি নামের এক মহাযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তাঁকে দাঁড়াতে হয়েছিল লাইনে। অবশেষে শত-সহস্র প্রতিযোগীকে টপকে তিনি সুযোগ পেয়ে যান পুলিশ লাইন স্কুলে।
একটু বড় হলে পরে ‘লাইন’ শব্দটির মাহাত্ম্য অন্যভাবে ধরা দেয় তাঁর কাছে। অ্যানালগ টেলিফোনের সেই যুগে লাইনে ক্রস কানেকশনে এক সন্ধ্যায় অপরিচিতা এক সম্মোহনী কণ্ঠস্বরের সামনে মুখোমুখি করে দেয় তাঁকে। পাশের বাড়ির রুকসানার বদলে তিনি লাইন মারতে শুরু করেন সেই অপরিচিতার সঙ্গেই। বিদঘুটে হস্তাক্ষরে লাইনটানা খাতায় আঁকাবাঁকা লাইনে লেখেন প্রেমের কাঁচা কাব্য। কখনো নির্জন রেললাইনে হাতে হাত রেখে হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বোনা।
কিন্তু স্বপ্ন নামের লাইনটার শেষ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকে বাস্তবতা। অচিরেই সেই প্রেমময় সম্পর্কের লাইন কাটা পড়ে অপটিক্যাল ফাইবারের মতো। সেই অপরিচিতার বাবা বিদ্যুৎ অফিসের লাইনম্যান হলেও দুই নম্বর লাইনে প্রচুর টাকা কামিয়ে ধনবান হয়েছেন। বাংলা সিনেমার সেই চিরায়ত ‘স্টোরি-লাইন’ খেটে গেল তাঁর জীবনেও। মুখে কদিনের না-কামানো দাড়ি আর রুখু রুখু চেহারা নিয়ে সেই অপরিচিতার বাড়ির সামনে গিয়ে একদিন তিনি গাইলেন, ‘আজ দুজনার দুটি লাইন ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে।’
জীবনের লাইন যে কখনোই সরল রেখা মেনে এগিয়ে যায় না। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করলেন, তাঁর জীবনের অভিধানে শুধু একটাই শব্দ বড় করে লেখা: ল-এ আকার, হ্রস্বই আর দন্ত্য-ন—লাইন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দৌড়ে লাইন, হল জীবনে খাবারের ক্যানটিনে লাইন, বেতন জমা দিতে ব্যাংকে লাইন, গোসলের জন্য বাথরুমে লাইন, ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকের অনুকম্পা পেতে তাঁর অফিস রুমের সামনে লাইন…বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে সনদ তুলতেও লাইন।
চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে লাইন। বসের মন জোগাতেও লাইন। প্রমোশনে লাইন, ডিমোশনেও লাইন। চাকরি জীবনে বেতন তোলার জন্য আবারও সেই লাইন। লাইনে লাইনময়।
এরপর একদিন সমাজের বেঁধে দেওয়া লাইন অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে যেতে সিঙ্গুলার থেকে প্লুরাল নাম্বার হয়ে যাওয়া, ব্যাচেলর ডিগ্রি বিসর্জন দিয়ে গলায় গামছা বেঁধে দাঁড়ানো ছাদনাতলায়। যেখানে সাতপাকের এক চক্রাকার লাইনে ঘুরপাক খেয়ে শুরু করা সংসার জীবন।
সেখানেও লাইনের সংকট। গ্যাস লাইনে গ্যাস নেই। পানির লাইনে কেবল বাতাস। কারেন্টের লাইনের কথা না তোলাই ভালো।
লাইনের ধাক্কায় লাইনচ্যুত হয়ে আবারও ট্রাকে ফেরার অদম্য বাসনায় জীবনের আয়ু ক্ষয় করে ফেলা। এরপর একদিন লাইন দেওয়া চিকিৎসকের চেম্বারে, পিজি হাসপাতাল কিংবা বারডেমে। এবং অবশেষে একদিন লাইন ধরে শুয়ে থাকা আজিমপুরে…চির শান্তির নিদ্রায়!
এই ‘তিনি’টা কে, কে তিনি, যাঁর জীবনের পরতে পরতে এভাবে মিশে আছে তিন অক্ষরের একটা শব্দ—লাইন! একটু ভেবে দেখুন, ভালো করে ভেবে দেখুন। এই তিনিটা কি আপনি নিজেও নন?
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১০, ২০১০
Leave a Reply