আমাদের পরিচয় হয়েছিল লাইব্রেরিতে। প্রথম দর্শনেই মেয়েটিকে আমার ভারি মনে লেগে যায়। চেহারায় একটু কঠোর ভাব, আত্মসংযমের অভিব্যক্তি তাতে স্পষ্ট। ঠিক আমার যেমন পছন্দ।
বই জমা দিতে মেয়েটি যখন দাঁড়িয়েছিল লাইনে, আমি গিয়ে দাঁড়ালাম তার পেছনে। তার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেওয়ার কোনো ছুতো আমার তৈরি করা ছিল না আগে থেকে। আমি সরলভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বইটা কেমন লেগেছে আপনার?’
‘এটা বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ,’ মেয়েটি উত্তর দিল। ‘পাঠকদের মধ্যে করা জরিপ অনুযায়ী জনপ্রিয়তার নিরিখে বইটির স্থান চতুর্থ। এই বইয়ের পাঠকদের মধ্যে কর্মজীবী নারীর সংখ্যাই বেশি, যাঁদের অধিকাংশেরই উচ্চশিক্ষা নেই।’
‘মজার ব্যাপার তো! আপনি এত সব খবর কোত্থেকে জানেন?’
‘আমি তো সমাজবিজ্ঞানী।’
এরপর আমাদের বারকয়েক দেখা হয়েছে লাইব্রেরিতে ও লাইব্রেরির বাইরে; এবং প্রতিবারই আমি সামাজিক জীবনসংক্রান্ত সংখ্যাবহুল নানাবিধ তথ্য জেনেছি। একদিন আমরা গেলাম সিনেমা দেখতে।
‘ছবিটা তোমার পছন্দ হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করলাম ওকে।
‘আমার ধারণা, ছবিটা মাঝারি গোছের ব্যবসা করবে।’
‘তা বুঝলাম, কিন্তু ছবিটা তোমার পছন্দ হয়েছে কি না, বলো।’
‘ছবিটা দেখবে বড়জোর ১০-১২ মিলিয়ন দর্শক।’
‘কিন্তু তোমার নিজের…’
‘সাধারণ দর্শকদের চাহিদা মেটাতে ছবিটা তৈরি করা হয়নি বলে অনেকেই দ্বিতীয়বার দেখতে উৎসাহ বোধ করবে না।’
‘তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?’
‘কারণ, আমি একজন সমাজবিজ্ঞানী।’
এরপর তার সঙ্গে আমার দেখা হলো অনেক দিন বাদে। একেবারেই হঠাৎ করে।
‘আমার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে তোমার হুট করে উবে গেল কেন?’ সে জানতে চাইল। ‘অথচ তুমিই না বলেছিলে, আমি তোমার পছন্দের মেয়ে…’
‘কারণ গত বছর বিয়ের তুলনায় ডিভোর্সের সংখ্যা ছিল ২৮ শতাংশ।’
‘আর এ বছর?’
‘সাড়ে ২৮ শতাংশ।’
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ’, সম্মতি জানিয়ে বলল সে। ‘আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিবাহবিচ্ছেদের প্রধান কারণ চরিত্রের বৈসাদৃশ্য।’
তার সঙ্গে আর কখনো দেখা হয়নি আমার। তা যা-ই হোক না কেন, সে কিন্তু ছিল খাঁটি সমাজবিজ্ঞানী।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১০, ২০১০
Leave a Reply