শীতের সকালে কম্বলের ওম থেকে বের হওয়া সহজ কোনো কাজ না। অথচ আমাকে সেই কঠিন কাজটাই করতে হলো। সব দোষ এই ফোনের। কড়া ঝাড়ি দেওয়ার বাসনা নিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি, মাসুদ কল করেছে। কদিন থেকেই টাকা-পয়সা আসার পূর্বাভাস হিসেবে হাতের তালু চুলকাচ্ছিল। মাসুদের ফোন দেখে নিশ্চিত হলাম। যাক, টাকাটা তাহলে পাচ্ছি। কিন্তু কম্বলের নিচ থেকে কি অত সহজে বের হওয়া যায়? ধরতে ধরতেই খাঁটি কলটা মিসড কলে পরিণত হলো। টাকা পাওয়া নিয়ে কথা! আমি কলব্যাক করলাম। রিং হচ্ছে, ওয়েলকাম টিউনে বাজছে বিখ্যাত গান, ‘নিঃস্ব করেছ আমায়, কী নিঠুর ছলনায়…’ ব্যাটা, তুই-ই তো আমাকে নিঃস্ব করেছিস। এ জীবনে তোকে যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছি, তার সুদ নিলে গুলশানে আমার একটা বাড়ি থাকত। শয়তানটা ফোন ধরেই আমার তোতলামি নিয়ে খোঁচা দিয়ে বলল,
জা-জা-জামাল? কেমন আছিস?
ভা-ভালো।
তোর ঘাড়ের ব্যথাটা কমেছে?
আ-আমার আবার কবে ঘাড়ব্যথা ছিল? ব্রেনটা কোরবানির গরুর ব্রেনের সঙ্গে ভেজে খেয়ে ফেলেছিস নাকি?
কী করে খাব, আমার তো ব্রেনই নেই। হা হা হা। শোন, আমার কিছু টাকা লাগবে।
কে-কেন? ব্রেন কিনবি?
আরে নাহ্। এই দেশে থাকার জন্য ব্রেন লাগে নাকি? আমি আসছি। তুই জিনিস রেডি কর।
আমার কাছে কোনো টাকা নাই।
মাই ফ্রেন্ড, আমি জানি, তোর কাছে টাকা আছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টাকা শেষ হতে পারে, কিন্তু তোর টাকা শেষ হবে না।
তুই তো আগের টাকাই শোধ করিসনি। আমি দিতে পারব না।
তুই কি কবির কথা ভুলে গেলি? কবি বলেছেন, ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর’…বেশি না, মাত্র পাঁচ হাজার দিলেই চলবে। আগামী বছর একসঙ্গে সব শোধ করে দেব।
আ-গা-মী বছর? অসম্ভব!
আরও দেরিতে চাস নাকি? ওরে অবুঝ, আগামী বছর আসতে আর দুই-তিন দিন বাকি। জানুয়ারির ১ তারিখেই সব দিয়ে দেব। নতুন বছরে তোদের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
এত টাকা দিয়ে কী করবি?
আরে, বছর শেষ হচ্ছে, আবার নতুন বছর আসছে। এ উপলক্ষে দুজনই গিফট দাবি করেছে। কী বিপদ। শেষে বুদ্ধি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছি। একজনকে বছর শেষের গিফট দেব, আরেকজনকে দেব শুরুরটা। বুদ্ধি কেমন?
দু-দুটো জলজ্যান্ত গার্লফ্রেন্ড থাকলে এ রকমই হয়। আমি তো নিজেকেই ম্যানেজ করতে পারি না। তুই দুজনকে ম্যানেজ করিস কীভাবে?
কেন? তোদের কাছ থেকে ধার নিয়ে! দিবি না ধার?
আচ্ছা, আয়। ১ তারিখেই দিয়ে দিস। ক্রাইসিসে আছি।
এই জন্যই তোকে এত ভালোবাসি। গোস্তর পরিচয় গন্ধে, আর দোস্তর পরিচয় বিপদে। ও শোন, আমি কিন্তু এসে নাশতা খাব। বাই।
পুরোই অস্থির! আজকালকার ছেলেগুলো সব এ রকম। হঠাৎ ফোনের ব্যালেন্স চেক করে দেখি ০.৩৩ পয়সা আছে। ধুর! কল যে আমি করেছিলাম মনেই ছিল না। ইশ্! মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমি আবার কম্বলের নিচে অবস্থান নিলাম। এতে যদি মনটা শান্ত হয়।
মাসুদ এসে মজা করে নাশতা খেল। জিজ্ঞেস করলাম,
থার্টি ফার্স্ট নাইটে কী করবি?
কী আর? তোর ধার শোধ করব।
সত্যি?
অবশ্যই। নতুন বছরের প্রথম প্রহরেই আমি ঋণমুক্ত হতে চাই। বছরটা একেবারে নতুন করে শুরু করব। মাঠে চলে আসিস। ব্যাডমিন্টন খেলা হবে। খেলা শেষে ধার শোধ। কিন্তু এর আগে ফোন দিয়ে ‘টাকা দে’ টাইপের ঘ্যান ঘ্যান করবি না।
ভদ্রলোকের জবান এক।
থার্টি ফার্স্ট নাইটে বের হওয়ার আগে মোটা জ্যাকেটটা পরে নিলাম। অনেকগুলো টাকা আনতে হবে তো। এটার পকেট নিরাপদ। হঠাৎ বাবার বাধা, কই যাস?
থার্টি ফার্স্ট নাইট তো, বন্ধুরা মিলে সেলিব্রেট করব।
খামোশ! জীবন থেকে একটা বছর চলে যাচ্ছে, আর তুই সেলিব্রেট করবি? মৃত্যুর দিকে যে এক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছিস, সে খেয়াল আছে? বের হওয়া নিষেধ। কারফিউ!
এ ধরনের বাবাদের কারণেই আমাদের জীবন বিভীষিকাময়। এ জন্যই মাঝেমধ্যে মনের দুঃখে সুন্দরবনে চলে যেতে ইচ্ছা করে। কী আর করা, বাবার আদেশ। মাসুদকে ফোন দিয়ে বলতে হবে আজ আসতে পারব না। নইলে ও আবার টাকা নিয়ে অপেক্ষা করবে। কিন্তু একি! ওর ফোন বন্ধ কেন? কয়েকবার চেষ্টা করেও পেলাম না। শালা ভাগল নাকি! তা-ই তো মনে হচ্ছে। চান্দু, পালিয়ে যাবি কোথায়! তোর দুটো গার্লফ্রেন্ডের নাম্বারই আমার কাছে আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওর ক্লোজ গার্লফ্রেন্ড টুশিকে ফোন দিলাম। ওপাশ থেকে ভেসে এল রাগী কণ্ঠ,
হ্যালো, কে?
টু-টু টুশি?
জি না, শুধু টুশি, আপনি কে?
জা-জা-জামাল
আপনি! আপনার খবর আছে। আপনার বন্ধু আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল, আজকে গিফটসহ ফেরত দেওয়ার কথা। ওদিকে গতকাল থেকে ফোন অফ। খোঁজ নিয়ে দেখি, উনি জীবিকার তাগিদে সাইপ্রাসে চলে গেছেন। ভাবতে পারেন? আমি আর কাউকে চিনিও না। এখন আপনি আমার টাকা জোগাড় করে দেবেন।
টা-টা…
কিসের টাটা? টাকা জোগাড় করে দেন, নইলে আপনার টাউট বন্ধুর ঠিকানা দেন। সাইপ্রাস হোক, আর মাদাগাস্কার হোক, ওর খবর আছে! আমার সঙ্গে বিটলামি!…
টুশির কোনো কথাই আমার কানে ঢুকছে না। নতুন বছরে মাসুদ সারপ্রাইজ দেবে বলেছিল। কিন্তু সেটা যে এত ভয়াবহ হবে, এটা জীবনেও ভাবিনি। আমি ফোন কেটে দিলাম। এক গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছি। আরেকজনকে ফোন দেওয়ার কোনো মানে হয় না। আমি আবারও কম্বলের নিচে অবস্থান নিলাম। কানে বাজছে মাসুদের সেই ওয়েলকাম টিউন, ‘নিঃস্ব করেছ আমায়, কী নিঠুর ছলনায়…’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৭, ২০১০
Leave a Reply