প্যারিস শহরের এক রেস্তোরাঁয় বসে সকালে দুই বন্ধু খবরের কাগজ পড়তে পড়তে চা খাচ্ছে। হঠাৎ এক বন্ধুর চোখ খবরের কাগজের এক জায়গায় পড়তে সে আঁতকিয়ে উঠল, সে অন্য বন্ধুকে দেখাল তারপর পড়ে শোনাল। ঘটনাটি সামান্য নয়, মাদাম দুভালের স্বামী মঁশিয়ে দুভাল গতকাল রাতে অতর্কিতে বাড়ি ফিরে এসে তাঁর স্ত্রীকে ঘরের মধ্যে এক অপরিচিত লোকের সঙ্গে দেখতে পান। মঁশিয়ে দুভাল কয়েকদিন আগে লন্ডনে গিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে ফেরার কথা ছিল, তাই হয়তো দুভাল-পত্নীর এই অসতর্কতা।
সে যা হোক, দুভাল সাহেব বাড়ি ফিরে সেই হতভাগ্য প্রেমিককে দড়ি দিয়ে জানালার গরাদের সঙ্গে বাঁধেন। তারপর নির্মমভাবে এক ঘণ্টা চাবুক মারেন এবং অবশেষে তাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে প্যারিস শহরের শীতের বরফজমা, কনকনে ঠান্ডায় রাস্তায় লাথি মেরে বাড়ির মধ্য থেকে বের করে দেন। পুলিশের গাড়ি দুর্ভাগাকে উদ্ধার করে রাস্তা থেকে তুলে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। যে বন্ধুটি খবরের কাগজটি অন্য বন্ধুকে পড়ে শোনাচ্ছিল সে বলল, ‘কী সাংঘাতিক! সামান্য অবৈধ প্রেমের জন্য এত লাঞ্ছনা! কী সাংঘাতিক ব্যাপার!’ যে শুনছিল সেই দ্বিতীয় বন্ধুটি খবর শুনে অনেকক্ষণ গুম হয়ে থেকে বলল, ‘এর চেয়ে আরও সাংঘাতিক হতে পারত।’
প্রথম বন্ধু বিস্মিত, ‘এর থেকে আর কী সাংঘাতিক হবে!’ দ্বিতীয় বন্ধুটি বলল, ‘কাল না হয়ে পরশু দিন হলেই আরও সাংঘাতিক হতো। পরশু দিন রাতে যে আমি ছিলাম দুভালমেমের বাড়িতে, সেদিন যদি দুভাল ফিরত!’
দ্বিতীয় কথিকাটি বিপরীতমুখী। আগের গল্পের স্বামী মারমুখী। আর এ গল্পে ভীরু, ভালো মানুষ স্বামী তাদের একজন যারা বউকে দখলে রাখতে পারে না, সাহেবরা যাদের শিং গজিয়েছে বলে উপহাস করে।
এক ব্যক্তির অফিসে খুব ক্লান্ত লাগছে। অথচ অফিস ছুটি হতে এখনো তিন-চার ঘণ্টা বাকি। এখন ভরদুপুর। তার সাহসের অভাব, অফিস থেকে পালাতে ভরসা করছে না। তার সহকর্মী তাকে বলল, ‘আরে, ভয়ের কী আছে, আজ তো বড়সাহেব অফিসে নেই। খুব সাজগোজ করে, ভুরভুরে আতর মেখে বেরিয়েছে। কোথাও ফুর্তি করতে গেছে, সহজে ফিরবে না। তুমি বাড়ি চলে যাও, কেউ তোমাকে ধরবে না।’
ক্লান্ত কর্মচারীটি সংশয়াকুল চিত্তে গৃহপানে রওনা হলো। তার বাড়ি কাছেই। ১৫ মিনিটের মধ্যে দেখা গেল সে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে অফিসে ফিরে আসছে। সে ফিরে এসে হাঁপাতে লাগল। একটু বিশ্রাম নেওয়ার পর তার পূর্ব পরামর্শদাতা তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি এমন ভয় পেয়ে ফিরে এলে কেন?’
কর্মচারীটি বলল, ‘তোমার পরামর্শ শুনে আজ আমি ঘোর বিপদে পড়েছিলাম।’
‘কী বিপদ?’ কিছুই বুঝতে পারছে না পূর্ব পরামর্শদাতা।
‘কী বিপদ?’ অফিস কেটে চলে যাওয়া বন্ধুটি ব্যাখ্যা করে বলল, ‘চাকরি যেতে বসেছিল। আজ চাকরি খোয়াতাম। বড় সাহেবের কাছে অল্পের জন্য ধরা পড়িনি যে অফিস পালিয়েছিলাম।’
পরামর্শদাতা পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘তার মানে?’
বন্ধুটি বলল, ‘তার মানে? বাড়ি ফিরে শোয়ার ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি, হঠাৎ শুনি বউ কার সঙ্গে খুব হেসে হেসে কথা বলছে। জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখি, বড় সাহেব আমার বিছানায় শুয়ে। ভাগ্যিস হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে যাইনি। তাহলেই ধরা পড়ে যেতাম। অফিস পালানো ধরতে পারলে সাহেব নিশ্চয়ই আমাকে বরখাস্ত করত। সেই ভয়েই তো একছুটে ফিরে এলাম অফিসে।’
বায়রন সাহেবের বেশ কিছুকাল আগে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার নামে এক নাট্যকার অত্যন্ত অনাসক্তভাবে পরকীয়া সম্পর্কে দু-চার হাজার কথা লিখেছিলেন। শেক্সপিয়ারের মতো হূদয়সন্ধানী মানুষকে অনাসক্ত বলছি এ কারণে যে তিনি নিজের সঙ্গে নিজেরই বিরোধ ঘটিয়েছেন।
তারাপদ রায়: সাহিত্যিক, রম্য লেখক হিসেবে খ্যাত। জন্ম ১৯৩৬, মৃত্যু ২০০৭।
Leave a Reply