একবার তাকে আদর-যত্নে তোলা হয়েছিল মাথার ওপরে। এখন টেনেহিঁচড়ে নামানো হচ্ছে পদতলে। কেউ যেন অযথাই তাৎপর্যপূর্ণ কিছু আবিষ্কার করার চেষ্টায় শীতের দিনে মাথা গরম করতে যাবেন না। এই বস্তুটির নাম ‘তার’। ঢাকা শহরের পথে যেমন দুই চাকা থেকে ১০ চাকাওয়ালা হরেক কিসিমের বেশুমার যানবাহনের নিরন্তর জটলা, তেমনি পথের ওপরে জটলা তারের। টানা, কুণ্ডলী পাকানো, গুচ্ছ গুচ্ছ তার। এর সঙ্গে দোসর লক্ষ্মণের মতো আছে নানা মাপের চোঙ, বাক্স প্রভৃতির সাহচর্য। তারের প্রবাহ সটান চলে গেছে টেলিগ্রাফ বা বিদ্যুতের খুঁটি বাহিত হয়ে পথের দুই পাশ দিয়ে।
কোথাও কোথাও এদের আঁটি বেঁধে পথের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি পার করা হয়েছে। তাতে দিব্যি তৈরি হয়েছে কৃষ্ণবর্ণ ঝুলন্ত সেতু। কী অসাধারণ উদ্ভাবনা! সেই সেতুর ওপর বসে বসে দোল খায় কাক-শালিকের ঝাঁক। তাদের পায়ের তলা দিয়ে অকল্পনীয় গতিতে প্রবাহিত হতে থাকে বিচিত্র্য তথ্য, চিত্র, গুপ্তসংবাদ ও প্রেম-ভালোবাসার আবেগ-আকুতিভরা বার্তা। এই তারগুলো মূলত অন্তর্জাল মানে ইন্টারনেট সংযোগের।
সরকার সম্প্রতি নয়ন মেলে দেখেছে, মসিবর্ণ তারের জঞ্জাল যত্রতত্র জটিল বাঁধন বেঁধেছে। জারি হয়েছে সেই বন্ধন থেকে ঊর্ধ্বলোককে অবমুক্ত করার ফরমান। কাজ চলছে। আকাশচারী তার এখন পাতালগামী। মাটিচাপা দেওয়ার আগে আপাতত এদের কাটা গুচ্ছ লুটিয়ে আছে পথে পথে। দুর্বলের ওপর অত্যাচার সমাজের কালজয়ী ঐতিহ্য। লিকলিকে তারগুলো মাটিচাপা দেওয়া হলেও স্বাস্থ্যবান বিদ্যুৎ বাহকেরা ভূ-উপরিস্থই থাকবে বহালতবিয়তে। রোদে পুড়বে, বৃষ্টিতে ভিজবে, দোল খাবে দুনিয়ার আলো-হাওয়ায়। কায়দামতো পেলে বেকায়দায় ফেলবে ধারক-বাহকদের। বিদ্যুতায়িত করে প্রাণ কেড়ে নিতেও কসুর করবে না। তারকে একেবারে তাড়িয়ে দেওয়া সহজ কম্ম নয়।
তারের তাৎপর্য সবচেয়ে ভালো বুঝেছিলেন আমাদের ঘরের ছেলে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। তারের ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তির নিদান হিসেবে তিনি উদ্ভাবন করলেন বেতারযন্ত্র। বাঙালির মন্দ কপাল। ফেরারির পিছে লেগে থাকা গুপ্তচরের মতো বাঙালির পিছে লেগে আছে ষড়যন্ত্র, বঞ্চনা ও দুরভিসন্ধির অলাতচক্র। আচার্য বঞ্চিত হলেন তাঁর কীর্তির স্বীকৃতি থেকে। আলোকচিত্র সাংবাদিকেরা রাজপথে মিছিলের ছবি তোলার সময় নেতাখ্যাতির প্রার্থীরা যেমন কনুই ব্যবহার করে কর্মীদের হটিয়ে সম্মুখে উদ্ভাসিত হওয়ার প্রয়াস পান, তেমনি বাঙালি আচার্যকে কনুই মেরে সাহেব মার্কনি এসে বাগিয়ে নিলেন খ্যাতির মুকুট। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। বাঙালি আচার্যকে বঞ্চিত করার প্রায়শ্চিত্ত করতেই কি না কে জানে, বেতারযন্ত্র পেলেও যান্ত্রিক সভ্যতা তারের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেল না!
বস্তুত তার কখনো তারকাঁটা হয়ে বিদ্ধ করছে, কখনো সংযোগের সূত্রধর হয়ে অক্টোপাসের (পলের আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক) মতো জড়িয়ে ধরছে আষ্টেপৃষ্ঠে। আমাদের চেয়ে বরং সাহেব-সুবোদেরই এ নিয়ে মুসিবত ঢের বেশি। তারকে তাঁরা চুলের চেয়েও সরু, ক্ষুরের চেয়েও শাণিত করে ফেলেছেন। তদুপরি ‘বিদায়’ বলতে পারছেন না তাকে। কখনো সেটি তুলছেন খুঁটির মাথায়, কখনো নামাচ্ছেন মাটিতে; এমনকি সাগরতলে তার মহাশয়ের সলিলসমাধি রচনা করেও নিশ্চিত হতে পারছেন কোথায়? কেন জানি মনে হচ্ছে, এ হলো তাঁদের বাঙালিকে বঞ্চনা করার অভিশাপ। সেই বঞ্চনার খেদে বাঙালিরা তো উদ্ভাবনের পথ মাড়ানোই বন্ধ করে দিল! তা না হলে কবেই তারকে পুরোপুরি তাড়িয়ে দেওয়ার কায়দা ঠিক ঠিক বের করে ফেলত বঙ্গসন্তানেরা!
সে যা-ই হোক, এই তার ‘তাহার’ নয়। তবু পথের ধুলায় এমন হেলায় ছড়ানো, খুঁটি থেকে ঝুলন্ত বেওয়ারিশ তার দেখে সেই তাহার কথাই মনে পড়ছে। সুরঞ্জনাকে যার সঙ্গে কথা না বলতে অনুরোধ করে জীবনানন্দের সন্দেহপ্রবণ জিজ্ঞাসা ছিল—‘কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে!’ সুরঞ্জনারা কি কারও কথা শোনে? একবার চলে গেলে ফিরে আর আসে কি তারা নক্ষত্রের রুপালি আগুনভরা রাতে?
বেতার তো ঢের আগেই পাওয়া গিয়েছিল। হাতে হাতে তারবিহীন টেলিফোনও উঠে এল। কতই না সুবিধে হলো তাতে। ডায়াল ঘোরাতে হচ্ছে না, ট্রাংকল বুক করে তীর্থের কাকের মতো হন্যে দিয়ে থাকতে হচ্ছে না, আরও কত্ত কী! তা সত্ত্বেও তারের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের কোনো তারতম্য ঘটেনি; তাকে আমরা মাথার ওপরে কিংবা পায়ের নিচে যেখানেই রাখি না কেন। তার শুধু বাহকই নয়, সংযোজকও। তবে তারের সংযোগ কেটে যায় কখনো কখনো। আবার সেই কাটা তার জোড়া দিয়ে, জড়িয়ে-পেঁচিয়ে নিয়েই চলছে জগৎসংসার। কিন্তু হায়! সুরঞ্জনাদের সঙ্গে সম্পর্কের তার কেটে গেলে সেই তার আর ‘লাগে না, লাগে না জোড়া…’।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২০, ২০১০
Leave a Reply