ঢাকাই ছবির এক দৃশ্যে বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিলেন চরিত্রাভিনেত্রী খালেদা আক্তার কল্পনা। এমন সময় আতঙ্কমাখা মুখে তাঁর তরুণী কন্যা ঢুকল কক্ষে। খালেদা আক্তার এবার বিছানা ছাড়লেন। অতি করুণ মুখ নিয়ে মেয়েকে শুধালেন, ‘তোকে নাকি গুন্ডারা কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিল?’ বুঝুন অবস্থা! মেয়ে অপহূত হয়েছে, আর সেই খবর জেনেশুনে আপন মাতা এফডিসির বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছেন! আমাদের ঐতিহ্যবাহী এফডিসির সিনেমায় গরুরা আকাশে ওড়ে, মৎস্যকুল ঘাস খায়—এ কোনো নতুন খবর নয়। পাশের বলিউডেও এই চর্চা বিরল নয়। তবে হলিউডও দেখা যাচ্ছে এই ধারা থেকে খুব বেশি পিছিয়ে নেই।
এমনিতে সব পরিচালকই চান তাঁর সিনেমায় কোনো খুঁত না থাকুক। এর পরও অনেক কিছুই চোখ এড়িয়ে যায় তাঁদের। কনটিনিউটির (ধারাবাহিকতা) ভুলই সবচেয়ে বেশি। সিনেমায় সব দৃশ্য একবারে ধারণ করা যায় না। সন্ধ্যাবেলায় নেওয়া একটি দৃশ্য পরদিন সকালেও
ধারণ করার প্রয়োজন হতে পারে। সে জন্য দৃশ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা
করা খুবই জরুরি। এই যেমন, ম্যাক্স পেইন-এর দুটি দৃশ্য পাশাপাশি দেখুন—প্রথম দৃশ্যে মৃতদেহ এক ভঙ্গিতে শুয়ে আছে, চুলগুলো ঝুলছে বিছানার বাইরে। পরের দৃশ্যেই আবার ভঙ্গি অন্য রকম—চুলসহ পুরো শরীর বিছানায় উঠে পড়েছে। মৃতদেহের নিশ্চয়ই নড়াচড়ার সুযোগ নেই! সুতরাং শুটিং চলাকালে দৃশ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য ঘরের দেয়াল, আসবাব থেকে শুরু করে নড়াচড়া—সবই অবিকল রাখতে হয়। এটাই কনটিনিউটি। ভুলভালের মধ্যে অনেক সময় আবার ছবির দৃশ্যে শুটিং দলের ক্রুদের মুখ, শব্দ ধারণ করার মাইক্রোফোন—এসবও এসে যায়। এমনই কিছু ভুল নিয়ে এবারের আয়োজন।
রোমান যুগে গ্যাস-সিলিন্ডার
খ্রিষ্টপূর্বকালের রোমান যুগের কাহিনি নিয়ে তৈরি হয়েছিল গ্ল্যাডিয়েটর। সেই পুরোনো যুগের আবহ আনার জন্য ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছিল সর্বাধুনিক কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজারি, স্পেশাল ইফেক্ট, বাস্তবানুগ অ্যাকশন দৃশ্য। মোটামুটি সবই ঠিক ছিল। গোলমালটা বাধে কার্থেজের যুদ্ধের সময়ে—একটি রথ উল্টে গিয়ে দেয়ালে আঘাত হানে, উল্টে যাওয়ার সময় কম্বলের ভেতরে লুকানো একটি গ্যাস-সিলিন্ডার ছবির পরিচালকের দৃষ্টি এড়ালেও দর্শকের চোখে ধুলো দিতে পারেনি। রোমান যুগে আর যা-ই হোক, গ্যাস অন্তত আবিষ্কৃত হয়নি! গ্ল্যাডিয়েটর ছবিতে সব মিলিয়ে পাওয়া গেছে ১৭৬টি ভুল।
টাইম মেশিন
কাভি খুশি কাভি গাম ছবির একটি ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্য, সময়কাল ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ সাল। দেখা যায়, অমিতাভ বচ্চন একটি এলসিডি প্লাজমা টেলিভিশন দেখছেন। কিন্তু ওই সময় এলসিডি প্লাজমা আবিষ্কার তো দূরের কথা, নামই শোনেনি কেউ। অন্য একটি দৃশ্যে (১৯৯১ সালের ফ্ল্যাশব্যাক) অমিতাভকে একটি নকিয়া ৯০০০ কমিউনিকেটর ব্যবহার করতে দেখা যায়, যদিও নকিয়ার ওই মডেলের ফোন রিলিজ হয়েছিল তারও পাঁচ বছর পর, ১৯৯৬ সালে।
অলৌকিক গর্ভ
স্ত্রীর গর্ভধারণের খবর শুনে কৃশ ছবির একটি দৃশ্যে রোহিত নিজের অবস্থার বিবরণ দিচ্ছিলেন এই বলে—দুই বছর ধরে তিনি টানা অধ্যাপনা করে যাচ্ছেন এবং পূর্বনির্ধারিত কিছু কাজ শেষে তবেই বাড়ি ফিরবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, রোহিত যদি দুই বছর বাড়ি থেকে দূরেই থাকেন, তাঁর স্ত্রী গর্ভবতী হলেন কীভাবে? জাদু নাকি!
জ্যাক স্পারোর জিন্স
পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান ছবির একটি দৃশ্যে ক্যাপ্টেন জ্যাক স্পারো যখন তাঁর অধীনদের কিছু একটা নির্দেশ দিচ্ছিলেন, তখন সাগরে শুটিং দলের একজন সদস্যকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, যাঁর পরনে ছিল টি-শার্ট, কাউবয় টুপি আর সানগ্লাস! ভাবুন, সেই সময়কার জ্যাক স্পারোদের পোশাক-আশাক কেমন ছিল। ছবিটায় সব মিলিয়ে ভুল শনাক্ত করা গেছে ২৪১টি।
আকাশে বিমানের মডেল বদল
১৯৯৫ সালের থ্রিলার ছবি দি ইউজুয়াল সাসপেক্টস-এর একটি দৃশ্যে দেখা যায়, একটি বিমান মাটির দিকে নেমে আসছে। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল, বিমানটি চার ইঞ্জিনবিশিষ্ট। কিন্তু সেটা যখন মাটিতে নেমে এল, তখন সেই বিমানে দেখা গেল মাত্র দুটো ইঞ্জিন, বাইরে দৃশ্যমান যন্ত্রপাতিও কেন যেন কমে এসেছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ওঠা আর নামায় দুটি ভিন্ন মডেলের বিমানের সচল চিত্র ব্যবহূত হয়েছে। পরেরটি সম্ভবত বোয়িং ৭৬৭ ছিল।
এই একই কাণ্ড আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগারের টার্মিনেটর ৩: রাইজ অব দ্য মেশিনস ছবিতেও ঘটেছিল। জন আর ক্যাথেরিন যখন তাঁদের ছোট্ট সেসনা বিমান নিয়ে রানওয়েতে, তখন ওই বিমানের মডেল নম্বর দেখা যাচ্ছিল এন৩০৩৫সি। কিন্তু বিমানটি যখনই আকাশপানে উড়ল, মডেল নম্বর বদলে হয়ে গেল এন ৩৯৭৩এফ। তবে বিমানটি যখন গন্তব্যে পৌঁছাল, তখন আবার পুরোনো মডেলেই (এন৩০৩৫সি) ফিরে আসে।
২০০৩ সালে মুক্তি পাওয়া এই অ্যাকশনধর্মী ছবিতে ৩৬টি ভুল এযাবৎ পাওয়া গেছে।
অলৌকিক ইস্তিরি
ফরেস্ট গাম ছবিতে একই দৃশ্যের কয়েক সেকেন্ড আগে-পরে দেখা যাচ্ছে ইস্তিরি নিজে নিজেই খাড়া অবস্থা থেকে শুয়ে পড়েছে।
ব্রিটিশ সড়কে মার্কিন সেনার জগিং
স্ট্যানলি কুবরিক তাঁর যুদ্ধবিরোধী ছবি ফুল মেটাল জ্যাকেট-এর চিত্রধারণ কাজ করেছিলেন ইংল্যান্ডের বিভিন্ন লোকেশনে। ছবির একটি দৃশ্যে দেখা যায়, মার্কিন মেরিন সেনারা জগিং করছেন ট্রেনিং ক্যাম্পে। যে সড়কে তাঁরা জগিং করছিলেন, সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল ব্রিটিশ রোড মার্কিং, যা কিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
ভুলে ভরা হ্যারি পটার
আলোচনায় যেমন, ভুলভালেও হ্যারি পটারের ছবিগুলো এগিয়ে আছে বেশ। এই যেমন হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফারস স্টোন ছবিটায় ভুল পাওয়া গেছে মোট ২১৭টি। ভাবা যায়!
এই ছবিতে ভোজ-উৎসবে হ্যারিকে দেখা গেল টেবিলের ডান পাশে বসা অবস্থায়। সেই ভোজ চলতে চলতেই হ্যারিকে পাওয়া গেল টেবিলের অপর প্রান্তে, সতীর্থ তরুণীর পাশে।
ওদিকে হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য চেম্বার অব সিক্রেটস-এ স্নেইপ যখন ম্যালফয়কে নিয়ে টানাহেঁচড়া করছিলেন, তখন স্ক্রিনের বাম কোনায় একজন ক্যামেরাম্যানকে দেখা যাচ্ছিল, যিনি বেশ মনোযোগ দিয়ে দৃশ্যটি ক্যামেরায় ধারণে ব্যস্ত। ২০০২ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিতে এরই মধ্যে ৩৭টি ভুল পাওয়া গেছে। আরও হয়তো পাওয়া যাবে সামনে। হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য অর্ডার অব দ্য ফিনিক্স-এ আবার আরেক কাণ্ড। ছবির একটি দৃশ্যে হ্যারিকে পাওয়া গেল গভীর ঘুমে মগ্ন অবস্থায়। পরনে বোতামহীন ‘গোল গলা’ গেঞ্জি। কিন্তু তিনি ঘুম থেকে যখন উঠলেন, গেঞ্জিতে দেখা গেল বেশ কয়েকটি বোতাম চেপে বসেছে, গেঞ্জির রংও বদলে গেছে। এই ছবিতে সাকল্যে ভুল মিলেছে ১০০টি।
সাদা হলো নীল
এক্স-ম্যান ২ ছবিতে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেছেন এক্স-ম্যান। ঠিক সেই সময় প্রেসিডেন্টের টেবিলের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, কিছু সাদা কাগজ ছড়িয়ে আছে ওপরে বাম কোনার দিকে স্ট্যাপল করা। পরবর্তী দৃশ্যেই আবার দেখা গেল, প্রেসিডেন্টের সামনে সাদা কাগজগুলো আর নেই, নীলরঙা প্রচ্ছদে বাঁধাই করা একটি খাতা ছবির পরিচালকের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে! এটাই একমাত্র নয়, আরও ১৯টি ভুল আছে অ্যাকশনধর্মী ছবিটায়।
থ্রি ইডিয়টিক কাণ্ড
বহুল আলোচিত থ্রি ইডিয়টস ছবিতে সন্তান জন্মের সময় পিয়া (কারিনা কাপুর) একটি দৃশ্যে ইউটিউবে ভিডিও দেখছিলেন। দৃশ্যটি ছিল তারও ছয় বছর আগের একটি ঘটনা নিয়ে। কিন্তু বাস্তবে তখন তো ইউটিউব সাইটটা চালুই হয়নি! আরেকটি দৃশ্যে আমির খান ও মাধবন এয়ারটেলের ইন্টারনেট ডেটা কার্ড ব্যবহার করছেন, শর্মণ জোশী তখন হাসপাতালে। দৃশ্যটি ১০ বছর আগের একটি ফ্ল্যাশব্যাক। প্রশ্ন হচ্ছে, ১০ বছর আগে এয়ারটেল ওয়্যারলেস ইন্টারনেট কোত্থেকে বাজারে ছাড়ল? তারপর দেখুন, ছবির শুরুর দিকে অভিনেত্রী মোনা সিংয়ের নাম ছিল পুনম, ছবির মাঝামাঝিতে বিনা নোটিশে তাঁর নাম দাঁড়ায় ‘মোনা’। সবশেষে তাঁকে ডাকা হতে থাকে ‘মোনা পুশ’ নামে।
ক্ষতচিহ্নের নড়াচড়া
যেকোনো অ্যাকশন দৃশ্যে কৃত্রিমভাবে আহত হওয়া একেবারেই মামুলি ব্যাপার। ছবির শুটিং চলাকালে দৃশ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে পাত্র-পাত্রীর আহত হওয়ার স্থানটি মনে রাখাও আবার খুবই জরুরি। লর্ড অব দ্য রিংস: দ্য রিটার্ন অব দ্য কিং ছবির একটি দৃশ্যে ফ্রোডোর মুখে একটি ক্ষতচিহ্ন দেখা যায়। কিন্তু পরবর্তী দৃশ্যেই লক্ষ করা যায়, সেই ক্ষতচিহ্নের অবস্থান ও আকার পরিবর্তন হয়ে গেছে। ক্ষতচিহ্ন আকারে বড় তো হয়েছেই, সেটা আবার মুখের ডান দিক থেকে বাম দিকে চলে এসেছে। ধরে নেওয়া যায়, ব্যাপারটা হয় অলৌকিক, নয়তো মেকআপ বিভাগের কারিশমা! সব মিলিয়ে এই ছবিতে খুব বেশি নয়, মাত্র ২২৫টি ভুল আবিষ্কার করা গেছে।
দি ইউজুয়াল সাসপেক্টস ছবিতেও এ রকম একটি কাণ্ড দেখা যায়। পুলিশের গাড়ি হাইজ্যাক করার পর ভিলেন নিজের হাতে সেটার সামনের কাচ ভেঙে চুরমার করে, একেবারে ঠিক কাচের মাঝ বরাবর। তবে ওই অবস্থাতেই গাড়িটি যখন চলতে শুরু করে, তখন ভেতর থেকে দেখা যায় ভাঙচুর নিজে থেকে সরে নিচের দিকে বাম কোনায় চলে এসেছে!
গাড়ির মেরামতি কোর্স
দুর্ঘটনায় পড়া গাড়ি নিজে থেকেই মেরামত হয়ে যাওয়া একটি যুগান্তকারী ঘটনা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগার অভিনীত ছবি কমান্ডোতে ঠিক এই ঘটনাই ঘটেছে। ছবির একটি দৃশ্যে আমরা দেখলাম, ভিলেনের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধের সময় শোয়ার্জেনেগারের গাড়ি ইয়েলো পোর্শের বাম পাশটা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। কিন্তু সামান্য পথ যেতে না যেতেই গাড়ির বাম পাশ তো বটেই, পুরো গাড়ি হয়ে গেল ঝকঝকে, নিখুঁত। গাড়িটা আগে কখনো মেরামতি কোর্স সম্পন্ন করেছিল কি না, সে বিষয়ে অবশ্য পরিচালক কিছু জানাননি। অ্যাকশনধর্মী ছবি কমান্ডোতে মিলেছে মাত্র ৫৬টি ভুল।
ফিউশন রহমান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৬, ২০১০
Leave a Reply