রোমের প্রথিতযশা আইনজীবীর রিসেপশন রুমে উদ্বিগ্ন মুখে কয়েকজন মক্কেল বসে ছিল ডাক পাওয়ার আশায়: ‘নেক্সট, প্লিজ।’ সেই সময় সেখানে ঢোকার অন্য দরজাটি খুলে গেল, লাইনের তোয়াক্কা না করে ঝড়ের বেগে রিসেপশন রুম পার হয়ে আইনজীবীর ঘরে ঢুকে পড়ল তন্বী, অপরূপা এবং স্পষ্টতই শঙ্কিত চেহারার এক মেয়ে।
‘কী প্রয়োজন আপনার, সেনিওরা?’ আইনজীবী উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে।
‘আমি এখনো সেনিওরিটা’, শুধরিয়ে দিল মেয়েটি। ‘আমার নাম সান্দ্রা। একটা কথা জানতে চাই আপনার কাছে, বান্ধবীকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও কোনো ছেলে তা ফিরিয়ে নিতে পারে?’
‘শান্ত হোন, বসুন’, আইনজীবী বললেন।
হাতের তালু দিয়ে নিজের রুপালি হয়ে যাওয়া চুলের ওপরে হাত বুলিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেয়েটি, খুব সম্ভব, আপনি?’
সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল সে।
‘হুমম…আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে আপনার হবু বর এমন করার অধিকার রাখেন না…যদি আপনার প্রতি তার প্রেম উবে গিয়ে না থাকে। কিন্তু আমার ধারণা, এটা অসম্ভব ব্যাপার!’
‘না, ও আমাকে আগের মতোই ভালোবাসে। একমাত্র প্রতিবন্ধক হচ্ছে তার বাবা!’
মুচকি হাসলেন আইনজীবী।
‘এ কেমন হবু বর আপনার! তার জায়গায় আমি হলে কোনো বাবাই সক্ষম হতো না আপনাকে বিয়ে করা থেকে আমাকে বিরত রাখতে।’
‘কিন্তু আমি তো দরিদ্র ঘরের মেয়ে…।’
‘আর সে ধনী পরিবারের? চিরন্তন ইতিহাস! কিন্তু সে তার প্রতিশ্রুতি পালন করতে বাধ্য।’
‘কিন্তু তার বাবা সর্বাত্মকভাবে বিরোধী হলে সে আমাকে বিয়ে করবে কীভাবে?’
‘আপনার হবু বর প্রাপ্তবয়স্ক তো? তাহলে বাবার অনুমতির প্রয়োজন একদম নেই।’
‘কিন্তু তার বাবা তো তাকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে।’
‘ননসেন্স!’ বললেন আইনজীবী। ‘যে কোনো অবস্থাতেই সম্পত্তির নির্দিষ্ট একটি অংশ ছেলে পাবেই।’
‘দুঃখের কথা এই, আমার হবু বর তার বাবাকে এতটাই ভয় পায় যে ওই জন্তুটাকে চটানোর চেয়ে সে বরং তার সুখ বিসর্জন দেবে।’
মেয়েটির চোখের পাতায় ঝুলন্ত অশ্রু আইনজীবীর মন স্পর্শ করল। তিনি হাত রাখলেন মেয়েটির কাঁধে।
‘মন খারাপ করবেন না। আমরা তার বাবাকে হারিয়ে দেব। আপনার কাছে তো প্রমাণ আছে যে ছেলেটি আপনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, তাই না? চিঠিপত্র আছে না? সাক্ষী? চমৎকার! তার বাবার পালানোর পথ নেই। সে আমাদের হাতের মুঠোয়। আমরা প্রমাণ করে দেব, বিয়ের আশায় আপনি চাকরি খুইয়েছেন।’
‘কিন্তু আমি তো…।’
‘সেটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়’, মেয়ের কথা কানেই তুললেন না আইনজীবী। ‘চাকরি তো আপনি হারাতেও পারতেন! আরও আছে: আপনার হবু বরের প্রত্যাখ্যানের কারণে আপনার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে…।’
‘কিন্তু আমি তো সম্পূর্ণই সুস্থ!’
‘ব্যাপার না! এটা আপনার ধারণামাত্র। শুধু আমি না, যে কোনো গড়পড়তা উকিল আদালতে প্রমাণ করে দিতে পারবে যে আপনার নার্ভাস সিস্টেম একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এরপর আপনার হবু বর, আর সঠিকভাবে বলতে গেলে তার বাবা বিরাট অঙ্কের জরিমানা দিতে বাধ্য থাকবে! আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, এই তথাকথিত পিতাকে—কঞ্জুস, স্বার্থপর, অহংকারী, ঠক খাওয়া চেহারার অভিব্যক্তি সারাক্ষণ মুখে!’
‘না, না, তাঁর চেহারা তাঁর ছেলের বর্ণনার চাইতে সুন্দর।’
‘হুমম…তাই বলে করুণা দেখানো উচিত হবে না। চেহারা অনেক সময়ই ভ্রান্তিকর হয়ে থাকে। আপনার নৈতিক ক্ষতিপূরণের জন্য আমরা দাবি করে বসব দুই মিলিয়ন লিরা। পাব হয়তো দেড় মিলিয়ন। তবে আপনার দ্বিধাগ্রস্ত হবু বরের সঙ্গে বিয়ের খরচ এতেই পুষিয়ে যাবে, কী বলেন?’
‘দেড় মিলিয়ন লিরা—সে তো অনেক টাকা! শুরুর দিকে আধা মিলিয়ন পেলেই আমাদের চলে যাবে…।’
‘দেড় মিলিয়নের কমে সম্মতি দেওয়ার কথা মাথাতেও আনবেন না। আর মুদ্রাস্ফীতির ব্যাপারটাও তো মাথায় রাখতে হবে। আমার কথা শুনুন। আর আপনাদের বিয়েতে অপরূপা কনের উদ্দেশে আমিই প্রথম পানপাত্র তুলে ধরব!’
‘না, না, আধা মিলিয়নেই চলে যাবে আমাদের। ফ্ল্যাটের ইনস্টলমেন্টটা দিতে পারব, কিছু আসবাবপত্রও কেনা যাবে। সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার হচ্ছে, এই টাকাটা আপনি দেওয়ার ব্যবস্থা করুন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব!’
‘কিন্তু টাকা আমাকে দিতে হবে কেন?’
আইনজীবীর গালে চুমু খেলো সান্দ্রা, তারপর বলল, ‘ওহ্! বলতে ভুলে গেছি, আমার হবু বর আপনার পুত্র।… সেনিওর, কী হলো আপনার?…’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৬, ২০১০
Leave a Reply