শ্রীযুক্ত রামবৃছ সিং শ্রীযুক্ত কমলকুমার মিত্রের প্রতিবেশী, পাশাপাশি বাড়িতে বাস করেন। পরিচয় বেশী দিনের নয়, কারণ উভয়েই অল্প কিছুদিন পূর্বে চাকুরি ব্যপদেশে এই শহরে আসিয়াছেন এবং দৈবাৎ পাশাপাশি দুইটি বাড়িতে ভাড়াটে-রূপে আশ্রয় লইয়াছেন। প্রথম প্রথম কিছুদিন উভয়ে উভয়ের পরিচয় লওয়াও প্রয়োজন মনে করেন নাই। সুযোগও ছিল না। দুইজন দুই বিভিন্ন আপিসে চাকরি করেন। একজন পোস্ট-অফিসে, একজন রেলে। নিজের নিজের আপিস আর সংসার লইয়াই দুইজনকে ব্যস্ত থাকিতে হইত, প্রতিবেশীর সংবাদ লইবার মত অবসর মিলিত না। ছুটির দিনেও না। ছেলেদের মধ্যে কিন্তু এতটা ঔদাসীন্য দেখা গেল না। কমলকুমারের দশ বছরের ছেলে অমলকুমার রামবৃছের বারো বছরের ছেলে ছবিলালের সহিত আলাপ করিয়া ফেলিল। তাহাদের আলাপ করিবার সুযোগও ছিল। একই স্কুলে একই ক্লাসে ভরতি হইয়াছিল তাহারা।
অমলকুমার একদিন তাহার মাকে বলিল, মা, জান ছবিলাল আমাদের সঙ্গে পড়ে, সে সেভ্ন্ বলতে পারে না, বলে—সেভুন। কমলকুমার আয়নার সম্মুখে নানা মুখভঙ্গি করিয়া দাড়ি কামাইতেছিলেন, তিনি প্রশ্ন করিলেন, ছবিলাল কে?
পাশের বাড়িতে থাকে। ওর বাবার নামটাও অদ্ভুত। রামবৃছ—
অমল হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। কমলকুমার বলিলেন, ও, বুঝেছি। রামবৃছ সিং আমাদের পাশের বাড়িতে আছে না কি?
হ্যাঁ।
গৃহিণীর দিকে তাকাইয়া কমলকুমার বলিলেন, ওঁর জায়গায় আমাদের বিশ্বেশ্বরবাবুর আসবার কথা ছিল। তিনি ওর চেয়ে সিনিয়র লোক, কিন্তু তিনি তো বিহারী নন, কোন মিনিস্টারের সঙ্গে তাঁর কোন আত্মীয়তাও নেই—
কমলকুমার বাঁকা হাসি হাসিয়া গাল চাঁছিতে লাগিলেন।
একটি নাতি-সুচরিত্রা ঠিকা দাই বারান্দা ঝাড়ু দিতেছিল। সে বাংলা বোঝে, রামবৃছবাবুর বাড়িতেও কাজ করে। সে যথাসময়ে উক্ত কথোপকথনটি রামবৃছবাবুর পরিবারে নিবেদন করিল। রামবৃছবাবুও সংবাদটি শুনিলেন। বলা বাহুল্য, তাঁহার চিত্ত অমৃত-নিষিক্ত হইল না। তিনি গোঁফে চাড়া দিয়া একটি উদ্গার তুলিলেন এবং মনে মনে বলিলেন, শালা বাঙালিয়া—
কমলকুমারের বাড়িতে সরবরাহ করিবার মত একটি সংবাদও একদিন উক্ত ঠিকা দাই সংগ্রহ করিয়া আনিল।
কমলকুমারের গৃহিণী সহসা একদিন সকালে হাতে আকাশের চাঁদ পাইয়াছিলেন। একজন ফেরিওয়ালা অপ্রত্যাশিতভাবে আসিয়া কিছু চিংড়িমাছ এবং নোনা-ইলিশ তাঁহাকে বিক্রয় করিয়া গিয়াছিল। তিনি মহাসমারোহে সেগুলি রন্ধন করিয়া ফেলিলেন। কিন্তু রন্ধনকালে সম্ভবতঃ রান্নাঘরের জানালাটি খোলা ছিল, চিংড়িমাছ এবং নোনা-ইলিশের গন্ধ বায়ু-বাহিত হইয়া রামবৃছ সিংয়ের অন্তঃপুরকে আমোদিত করিয়া তুলিল। রামবৃছ তখন রহরকা দাল ও নিমকি সহযোগে মোটা আটার রোটি চর্বণে ব্যাপৃত ছিলেন। গন্ধ পাইয়া তাহার ভ্রূ কুঞ্চিত হইল।
দাইকে সম্বোধন করিয়া প্রশ্ন করিলেন, ঘর মে কোই জানবর মরল বা?
দাই মুচকি হাসিয়া আড়ঘোমটা টানিয়া নিবেদন করিল যে, না, কোনও জানোয়ার মরে নাই, পাশের বাড়ির বাঙালিন বহু মৎস্য রন্ধন করিতেছেন।
রামবৃছ নাকে কাপড় দিয়া বলিয়া উঠিলেন, আরে, ছি ছি ছি! ই বাংগালি লোগ আদমি নেই থে, গিধ্ বা। অর্থাৎ বাঙালীরা মানুষ নয় শকুনি, মরা জানোয়ার খায়।
ঠিকা দাইটি কমলকুমারের পত্নীর নিকট এই খবরটিও যথাসময়ে মুচকি হাসিয়া নিবেদন করিল।
আপিস হইতে ফিরিয়া কমলকুমারও সংবাদ শুনিলেন। একটু উচ্চাঙ্গের হাস্য করিয়া তিনি মন্তব্য করিলেন, ও বেটা ছাতুখোর মাছের মর্ম কি বুঝবে?
এ খবরটিও রামবৃছের অবিদিত রহিল না। উভয় পক্ষেই উত্তাপ বাড়িতে লাগিল। তাহা হু-হু করিয়া বাড়িয়া গেল যখন রামবৃছ একদিন শুনিলেন যে, একজন সিনিয়র বাঙালীকে ডিঙাইয়া তাঁহাকে প্রমোশন দেওয়া হইয়াছে—এ খবরটি বঙ্গদেশ হইতে প্রকাশিত কোনও ইংরেজী পত্রিকায় কে. কে. নামক পত্রলেখক প্রমাণসহ বাহির করিয়া দিয়াছেন। রামবৃছ আগুন হইয়া উঠিলেন। তাহার বদ্ধমূল ধারণা হইল, কে. কে. কমলকুমার ছাড়া আর কেহ নন। তিনি নিজের ইয়ারমহলে বাঙালীদের শ্রাদ্ধ করিতে লাগিলেন।
শ্রাদ্ধের আয়োজন কমলকুমারও করিলেন। তাঁহার পুত্র অমলকুমার অতিশয় কম নম্বর পাইয়া কোন ক্রমে ক্লাস-প্রমোশন পাইয়াছিল এবং বাড়িতে আসিয়া বলিয়াছিল যে, শিক্ষকেরা সব হিন্দী ভাষায় পড়ান, সে কিছুই বুঝিতে পারে না। তাহা ছাড়া তাঁহারা পার্শিয়ালিটি করিয়া বেহারী ছেলেদের বেশী নম্বর দেন। কমলকুমার ইহা শুনিয়া যে সব ভাষা ব্যবহার করিলেন তাহা রীতিমত সাহিত্যিক ভাষা।
রামবৃছ সিংয়ের বাড়ির সামনের নর্দমায় একদিন জল আটকাইয়া গেল। দেখা গেল মাছের আঁশ ও নাড়িভুঁড়ি আসিয়া জলনিকাশের পথ রুদ্ধ করিয়াছে।
রামবৃছ দন্ত কড়মড় করিয়া বলিলেন, শালা মছলিখোর!
দোলের দিনে রামবৃছের পরিবারবর্গ কাদায় রঙে কিম্ভূতকিমাকার হইয়া অশ্রাব্য ভাষায় ‘হোলি’ গাহিতে লাগিল।
কমলকুমার কানে আঙুল দিয়া বলিতে লাগিলেন, ব্যাটা বেহারী ভূত!
এই ভাবেই কিছুদিন চলিল। হয়তো বরাবরই চলিত; কিন্তু একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনায় সব ওলটপালট হইয়া গেল।
রামবৃছ সিং একদিন লক্ষ্য করিলেন যে, কমলকুমারের বাড়ির সম্মুখস্থ ময়দানে একটি সামিয়ানা খাটানো হইয়াছে। সামিয়ানার নীচে টেবিল-চেয়ারও অনেক আনা হইল। ফুলের মালাও অনেক আসিল। সন্ধ্যার সময় শহরের অনেক বাঙালী যুবক আসিয়া সমবেত হইলেন। কৌতূহলী রামবৃছ একজনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, এ সব কেন?
সে উত্তর দিল, বাংলা ভাষার বিখ্যাত সাহিত্যিক ‘নবজীবন’-এর নাম শুনেছেন?
খুব।
তাঁর আজ জন্মদিন। তাঁকে আমরা সম্বর্ধনা জানাব বলে এই আয়োজন করেছি।
‘নবজীবন’ কি এখানে এসেছেন?
আরে, তিনি তো আপনার বাড়ির পাশেই থাকেন। তাঁর আসল নাম কমলকুমার ঘোষ। এখানকার এ. এস. এম.।
রামবৃছের আর বাক্যস্ফুর্তি হইল না, মুখটা একটু ফাঁক হইয়া গেল কেবল।
সম্বর্ধনা-সভা শেষ হইয়া গিয়াছে। শেষ যুবকটির সহিত কথাবার্তা কহিয়া কমলকুমার যখন বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিতে যাইতেছেন, তখন রামবৃছ আসিয়া প্রবেশ করিয়া বলিলেন। শুনিয়ে—
কমলকুমার ঘাড় ফিরাইতেই রামবৃছ করজোড়ে বলিলেন, পহলেই ম্যায় মাফি মাংতা হুঁ। মুঝে মালুম নহি থা যে আপহি নবজীবন হ্যঁয়। ম্যয় আপকা ভকত হুঁ।
কমলকুমারও হাতজোড় করিয়া ক্ষমা ভিক্ষা করিলেন। রামবৃছ বলিলেন যে, তিনি যদিও বাংলা বলিতে পারেন না কিন্তু বাংলা বুঝিতে পারেন। ‘নবজীবন’-লিখিত অনেক গল্প তিনি অনুবাদ করিয়া প্রকাশও করিয়াছেন। কমলকুমার বলিলেন, তাই নাকি? ‘স্রোত’ নাম দিয়ে আর একজন লেখকও আমার গল্পের চমৎকার অনুবাদ করেছেন দেখেছি।
রামবৃছ হাতজোড় করিয়া স্মিতমুখে কিছুক্ষণ নীরব রহিলেন, তাহার পর বলিলেন, ম্যয় স্রোত হুঁ।
উভয়ে গাঢ় আলিঙ্গনে বদ্ধ হইলেন।
বনফুল: প্রখ্যাত সাহিত্যিক।আসল নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়।
Leave a Reply