আমার বন্ধু ফটিকের মাথায় হাজার হাজার পরিকল্পনা ঘুরে বেড়ায়। শুধু ঘুরেই বেড়ায় না, এই পরিকল্পনাগুলো ওর মাথায় রীতিমতো ল্যাং মারতে থাকে।
তবে ফটিকের পরিকল্পনাগুলো নিছক পরিকল্পনা থাকে না, শেষ পর্যন্ত ওগুলো একেকটি প্রজেক্ট হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, বছর দুয়েক আগে একটি মুঠোফোন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান জনগণের কাছে আহ্বান জানাল, সবাই যেন তাদের স্বপ্নগুলোর কথা লিখে জানায়। ফটিক সেই স্বপ্নপূরণের ফরম সংগ্রহ করল এবং পায়ের ঘাম মাথায় তুলে সে স্বপ্ন দেখতে লাগল যে সে সংগীতজগতের একটি নক্ষত্র হিসেবে আবির্ভূত হবে। কেননা, এর কিছুদিন আগে থেকেই সে সংগীতের প্রতি তুমুল আবেগ অনুভব করছিল। তারপর দ্রুত বেগেই সে পরিকল্পনা করে ফেলল যে সে গানের সুর করবে, সংগীতায়োজন করবে এবং চট্টগ্রামেই একটি আন্তর্জাতিক মানের স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করবে। যেখানে কাজ করার জন্য ঢাকার নামীদামি শিল্পীরা তো বটেই, ভারত থেকে এ আর রহমানও ট্রেনে চেপে চট্টগ্রামে চলে আসবেন। আমরা ফটিকের এই পরিকল্পনায় সাংঘাতিক আপ্লুত হলাম এবং ওর স্টুডিওতে একটি চাকরি যেন পাই, তার জন্য খুব তদবির করলাম। ফটিক অবশ্য তার ব্যস্ততার জন্য সেই স্বপ্নপূরণের ফরম পাঠাতে পারল না। তবে তার পরিকল্পনায় সে পিছপা হয়নি। আমাকে বলল, ‘তুই আমাকে একটি গান লিখে দে, আমি প্রথমে তোর গান দিয়েই কাজ শুরু করে দিই।’
ফটিককে গান লিখে দেওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার ইহজন্মে ছিল না। কিন্তু ও মাঝেমধ্যে ওর নিজের সম্মানার্থে আমাদের বিরিয়ানি, কাবাব—এসব উদরস্থ করায় বলে না করতে পারলাম না।
ফটিক হারমোনিয়াম নিয়ে তার স্বপ্নপূরণের প্রথম কয়েক দিন পার করল। কয়েক দিন পর সে আমাদের ডেকে তার সুর করা গানটি শোনাল। সুর শুনে আমার কেন জানি মনে হলো, কেউ একজন হোটেলের ওয়েটারকে ডেকে এক কাপ চা আর দুটি পরোটা দিতে বলছে। মনে হয় অন্যদেরও একই রকম অনুভূতি হয়েছিল, তাই ঝুঁকি নিয়ে হলেও সবাই ওকে তিরস্কার করায় ও তখনই রণে ভঙ্গ দিল।
তারপর অনেক দিন তার কোনো খোঁজ নেই। অনেক দিন পর একদিন আমার কাছে ফোন করল, ‘দোস্ত, নতুন একটা বিজনেস করতেছি, দোয়া করিস।’
আমি অবাক হলাম, ‘কিসের বিজনেস করিস?’ ‘লাইভ দেখা হলে সবকিছু বিস্তারিত বলব’ বলে ফোন কেটে দিল।
ওর নতুন বিজনেসের কথা শুনতে একদিন ওর সঙ্গে দেখা করলাম। ও বলল, ‘দোস্ত, একটা এনজিওর ডিরেক্টর হইছি। আগে কাজ করে কিছু অভিজ্ঞতা নিই, তার পরে বিপ্লব ঘটামু। তোদের কোনো কাজ নাই, তোরা শুধু দোয়া করবি।’
ফটিক এনজিওর ডিরেক্টর হয়েছে শুনে আমার কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়ার দশা হলো। অবশ্য ওকে যে এনজিওর ডিরেক্টর বানিয়েছে, সেই এনজিও আর কত দিন জীবিত আছে, তা জানতেও ইচ্ছে হচ্ছিল। সামলে নিয়ে বললাম, ‘কিসের বিপ্লব ঘটাবি?’
ফটিক বলল, ‘মাইক্রো ক্রেডিটের জগতে বিপ্লব ঘটামু। এমন পরিকল্পনা করছি, ক্ষুদ্রঋণের জগতে নতুন পরিকল্পনা নিয়া আসমু। ড. ইউনূস তো নোবেল পাইছে, আমি অস্কার পাওয়ার চিন্তা করতেছি।’ ওর কথা শুনে আমাদের হার্ট অ্যাটাক হবে হবে করছে দেখে ও বলল, ‘ফাজলামি না দোস্ত, সিরিয়াস। ক্ষুদ্রঋণের জগতে নতুনত্ব আনমু। আর কিছুদিন পরেই দেখবি, আমার নাম পুরা বিশ্ব জাইনা যাইব। একদিন আমার অফিসে আসিস।’
আমরা একদিন ওর অফিসে গেলাম। ওকে বসার জন্য একটি ডেস্ক দেওয়া হয়েছে। অফিসে আর কোনো লোকই নেই। ফটিক একলা বসে বসে নিচে চাকা লাগানো চেয়ার চড়ে বেড়াচ্ছে।
আমরাও কিছুক্ষণ ওই চেয়ারে পালাক্রমে চড়লাম।
তারপর কিছুদিন পরে শুনি, ওই এনজিও (ওইটি নাকি আদৌ কোনো এনজিও ছিল না) ফটিকের মতো আরও কয়েকজন ডিরেক্টর এবং বিপুলসংখ্যক গ্রাহককে মর্তমান কলা দেখিয়ে সটকে পড়েছে। ফটিক এখনো ওই এলাকায় যায় না, গ্রাহকেরা পেলে ওকে বেশ জামাই আদর করবে এই আশঙ্কায়।
তারপর ফটিক আবারও ডুব দিল। অনেক দিন ওর কোনো খবর পাই না। হঠাৎ করে গত বছর রমজান মাস শুরু হওয়ার সময় সে একদিন ফোন করল। সন্ধ্যার সময় ফোন করে বলল, ‘যত তাড়াতাড়ি পারিস, কাজীর দেউড়ী মোড়ে চলে আয়।’
গিয়ে দেখি, ফটিক রাস্তার পাশে বসে বিরাট এক ডেকচি নিয়ে বিরিয়ানি বিক্রি করছে। আমাদের দেখে অমায়িক হেসে বলল, ‘ফুল প্লেট ২৫ টাকা, হাফ প্লেট ১৫ টাকা। তবে তোদের মাগনা খাওয়াব, প্রতিদিন এসে খেয়ে যাস।’
জুয়েল দেব
আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২২, ২০১০
Leave a Reply