কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই—জব্বার মাস্টার রিটায়ার করিয়া প্রমাণ করিল সে মাস্টারি পেশা ছাড়ে নাই। যত দিন চাকরি ছিল তত দিন তবুও মানুষটা স্কুলের চার দেয়ালের ভেতরে গোনাগুনতি ছাত্রদের সিলেবাসের বাঁধাধরা জ্ঞান দেওয়ার মধ্যে বাঁধা ছিল। এখন রিটায়ার করে যেন ঘরের বিড়ম্বনা দশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। জব্বার মাস্টার রিটায়ার করে সপ্তাহ পার হওয়ার আগেই স্বেচ্ছা গৃহবন্দী জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে এসে কিশোরগঞ্জ শহরের গৌরাঙ্গ বাজারে তিন রাস্তার মাথায় চায়ের দোকানে বসে। সকাল নয়টা বাজতে এ-পাড়া ও-পাড়ার ছেলেমেয়েরা এই পথ ধরে স্কুল যেতে শুরু করতেই জব্বার মাস্টারের পুরোনো মাস্টারি রোগ মাথার মধ্যে চাড়া দিয়ে ওঠে।
আধ-খাওয়া চায়ের কাপ টেবিলে হেলায় নামিয়ে রেখে সে রাস্তার মোড়ে এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘ওই ছ্যাড়া, বিষয়টা কী? ছালাম দিলি না।’ সালামের আশায় সময় নষ্ট না করে জব্বার মাস্টার দ্রুত প্রশ্নোত্তর পর্বে ঢুকে গিয়ে বলে—
—বল, নৌকার ইংরেজি কী?
ছেলেটার ঝটিতি জবাব,
—নৌকার ইংরেজি ‘বুট’।
তারপর প্রশ্নের বাণ একটার পর একটা ছেলেটার দিকে ছুটে আসতে থাকে, এবার হালের ইংরেজি বল। বল দেখি পালের ইংরেজি কী? গলুইয়ের ইংরেজি জানিস? আচ্ছা যা। তোর স্কুলের ইংরেজি মাস্টাররে জিগাইয়া গলুইয়ের ইংরেজি শিইখা আইসা কাল আমারে এইখানে এই সময় রিপোর্ট করবি। ছেলেটি অতি ধুরন্ধর। পরদিন সে নিজে এই পথ এড়িয়ে ঘুরপথে স্কুলে গেছে, সেই সঙ্গে গৌরাঙ্গ বাজারে জব্বার মাস্টারের উপস্থিতির বৃত্তান্ত বন্ধুদের ঢাক পিটিয়ে জানিয়ে দেয়। ছাত্রের জীবন মাস্টার বিনে আটকে থাকে না কিন্তু ছাত্র বিনে মাস্টারের জীবন চলে না। জব্বার মাস্টার এই শহরের ছাত্রদের নখরামী ধরতে পেরে তার কৌশলগত অবস্থান বদলায়। পরদিন সকাল সকাল রথখোলার মোড়ে দাঁড়িয়ে ইতিউতি চাইতেই স্কুলগামী এক ছাত্র সোজা তার হাতের মুঠোয়।
এ ছেলেও যথারীতি ‘নৌকা মানে বুট’ পর্যন্ত বলেই একেবারে উধাও। স্কুলের বেলা বয়ে যাওয়ার দোহাই দিয়ে সেদিন মাস্টারের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ভুলেও সে আর এ-পথ মাড়ায় না। তার চেয়ে বড় কথা, সে ধড়িবাজ ছেলে মাস্টারের অবস্থান ফাঁস করে দেওয়ায় বাকিরাও সাবধান হয়ে গেল।
জব্বার মাস্টার দমে যাওয়ার পাত্র নয়। জায়গা বদল করে সে এবার কাছারি বাজারে ঝুড়ি-টুকরির দোকানের কোনায় জানু ভিড়িয়ে বসে। খুদে বদমাশগুলো ধরা না দিয়ে যাবে কোথায়? সে নিয়ত করে রেখেছে, আজ তার প্রশ্নের বাণ নৌকা ছেড়ে নদীতে নামবে। বদমাশগুলো নদীর স্রোতের ইংরেজি বলতে পারলেও নদীর পাড়ের ইংরেজি বলতে পারবে না—পাড়ের ইংরেজি বলতে পারলেও নদীর তলায় গিয়ে ঠিকই আটকাবে।
সকালবেলা স্কুলযাত্রী ছেলেগুলো যথারীতি কাছারি বাজারের পথ ধরে এগিয়ে আসে। ওদের সঙ্গে অতিশয় ত্যাঁদড় চেহারার কয়েকটা মেয়েও আছে। মাস্টারের দিক থেকে কোনো প্রশ্ন শুরু হওয়ার আগেই একটা মেয়ে ঠোঁটের কোণে পিছলা হাসি ঝুলিয়ে রেখে মিহি গলায় আবদারের সুরে বলে—
—স্যার, ইভ টিজিংয়ের ইংরেজি কী?
—আরে, এইটা কী আজব প্রশ্ন! ইভ মানে ইভ আর টিজিং মানে ত্যক্ত করা। ইভরে কে ত্যক্ত করবে?
অ্যাডাম? কেন? ইভরে অ্যাডাম কোথায় ত্যক্ত করল? ইডেনের বাগানে নাকি দুনিয়ায়? কী সর্বনাশ। এ অতি আশ্চর্য কথা।
বেমক্কা ধন্দে পড়ে আজ মাস্টারের মেজাজ খারাপ। ইভ টিজিং শব্দটি তাকে ভাবিয়ে তোলে। এমন শব্দ সে ডিকশনারিতে দেখেছে বলে মনে পড়ে না। তড়িঘড়ি ঘরে ফিরে সে তন্ন তন্ন করে ডিকশনারির পাতা ওল্টায়। কিন্তু কোথাও সে এমন শব্দের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায় না। দিনভর খোঁজাখুঁজি শেষে পাদটীকায় শব্দটির পরিচয় মেলে। ইভ টিজিং শব্দটি একান্ত বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ভারত ঘরানার। ইভ টিজিং একবারে একান্ত প্রাচ্য সংস্কৃতি।
মাস্টারের মনে চিন্তা, ইংরেজের দেশে ইভ টিজিং ব্যাপারটি থাকলে ইভ টিজিং শব্দটি নিশ্চয়ই ডিকশনারিতে থাকত।
জব্বার মাস্টার লজ্জায় আর কোনো দিন ডিকশনারি খোলে না।
তুষার কণা খোন্দকার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২২, ২০১০
Leave a Reply