প্রতিটা ঘটনা ও চরিত্র সত্য
মানুষ হিসেবে মানুষের এই পৃথিবীতে আমাকে মাঝেমধ্যে বেশ অপমানের শিকার হতে হয়েছে।
হাতিরপুল বাজারে ফুটপাতে একজন ফলবিক্রেতা বসে আছেন। সকালবেলা। আমি একটা পাকা পেঁপে কিনব। আমি বিক্রেতাকে বললাম, আপনার কাছে কি ওষুধ ছাড়া পেঁপে হবে?
উনি বললেন, ‘না, আমার কাছে ওষুধ ছাড়া কোনো পেঁপে নাই। সব পেঁপেতেই ওষুধ দেওয়া।’
কিন্তু পেঁপেগুলো দেখতে বড় ভালো ছিল। আমি একটা পেঁপে হাতে নিয়ে বললাম, ‘এটার দাম কত?’
তিনি বললেন, ‘১০০ টাকা।’
আমি বললাম, ‘৮০ টাকায় দেবেন।’
তিনি বললেন, ‘৯০।’
আমি বললাম, ‘না, ৯০ না। ৮০ টাকা।’
তিনি বললেন, ‘আপনি একটা কাজ করেন। কেজি হিসেবে কেনেন।’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা কেজি হিসেবে কিনব। কত করে কেজি?’
উনি বললেন, ‘১২০।’
আমি বললাম, ‘১০০।’
শেষে ১১০ টাকা কেজি রফা হলো। আগের পেঁপেটাই পাল্লায় তোলা হলো। দেখা গেল এটা দেড় কেজি হয়েছে। উনি বললেন, ‘১৬৫ টাকা দেন।’
আমি হেসে বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। যান ৯০ টাকাতেই নিচ্ছি। আপনার কথাই রইল।’
উনি বললেন, ‘না, আমি আপনাকে ৯০ টাকায় দিতে চাইছি। আপনি তো সেইটাতে রাজি হন নাই। এখন নিতে হইলে আপনারে ১৬৫ টাকাই দিতে হইব।’
আমি বললাম, ‘সে কী করে হয়।’
তিনি বললেন, ‘আপনার কাছে আমি পেঁপে বেচুম না। আপনি যান।’
আমি কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম। সকালবেলা এই অপমান হজম করে পেঁপে না কিনেই আমাকে চলে আসতে হলো।
এলিফ্যান্ট রোডের একটা বিখ্যাত ফটো স্টুডিও। আমি এক বিকেলবেলা সেখানে গেছি দুটো পেনসিল ব্যাটারি কিনতে। দাম ছিল ৩৫ টাকা। আমার মনে হলো, আমি ১০০ টাকার একটা নোট দিলাম। খুব অন্যমনস্ক ছিলাম। ওরা আমাকে ফেরত দিল ১৫ টাকা। আমি বললাম, আমার মনে হচ্ছে আমি ১০০ টাকা দিয়েছি। আপনি কি দয়া করে ড্রয়ারটা খুলে দেখবেন ১০০ টাকা দিয়েছি, নাকি ৫০ টাকা? উনি ভীষণ তেড়ে উঠলেন।
সঙ্গে সঙ্গে ওই স্টুডিওর সব দোকানিও একযোগে তেড়ে উঠলেন, যেন আমি একজন ভীষণ সন্ত্রাসী। ‘মিয়া, লোক ঠকায়া টাকা লইতে চান। যান, বাইরান।’
আমি মাথা নিচু করে বাইরে চলে এলাম।
ওই দোকানে আমি এখনো যাই। ছবি তুলি। টাকা আদান-প্রদান করি। এত ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মন খারাপ করে থাকলে চলে না।
আমাকে একবার ছিনতাইকারী ধরেছিল। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের সময়। সাপ্তাহিক পূর্বাভাস অফিসে কাজ করি তখন। স্টেডিয়ামে অফিস। সেখান থেকে রাত ১২টার পরে রিকশা করে বকশীবাজারের দিকে আসছি। শহীদ মিনারের সামনে দেখি একটা রিকশায় এক মহিলা। তাকে ঘিরে আছে দুই-তিনজন লুঙ্গি পরা লোক। ব্যাপার কী ভাবছি। এমন সময় লুঙ্গি পরা লোকগুলো আমার রিকশার দিকে তেড়ে এল। তাদের হাতে ভোঁতা দা। তারা বলল, ‘এই, যা আছে দিয়া দে।’ আমার পকেটে ছিল মাত্র ১০০ টাকা আর একটা ঘড়ি। সেটার দামও ২০০ টাকার বেশি না। তারা বলল, ‘আর কিছু নাই?’
আমি বললাম, ‘জি না।’
তারা বলল, ‘ঢাকা শহর দেখি ছোটলোক দিয়া ভইরা গেছে। এই রকম ছোটলোকের লগে কারবার করলে তো না খায়া মরতে হইব। ভাগ হারামজাদা। খবরদার পিছনের দিকে তাকাবি না।’
আমি কম্পবক্ষে ওই রিকশায় চড়েই সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। পেছনের দিকে তাকানোর সাহস ছিল না।
রিকশার ভাড়া কোত্থেকে দিয়েছিলাম মনে নাই। তবে মনে আছে, বহুদিন রাস্তায় চলাচলের সাহস হারিয়ে ফেলেছিলাম। আর কী হয়েছিল জানেন, খুব অপমানিত বোধ করেছিলাম। কটা টাকা পকেটে না রাখার অপরাধে লোকগুলো আমাকে ছোটলোক বলল। টাকাই কি সব? আমার পকেটে হাজার টাকা থাকলে তোরা খুশি হতি? এরপর সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা পকেটে না থাকলে আমি কোনো ছিনতাইকারীর পাল্লায় পড়ব না। বারবার অপমানিত হওয়া ঠিক নয়।
আমাকে সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করে পুলিশ ডেকেছিলেন মতিঝিলের এক স্কুলের শিক্ষক। এই ঘটনাটা বলে এই লেখা শেষ করব। বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিতে গেছি। কম্পিউটারের মাধ্যমে এই উত্তরপত্র দেখা হবে। তাই উত্তরপত্রে পেনসিল দিয়ে গোল ঘর পূরণ করে উত্তর দিতে হয়। পরীক্ষা এখনো শুরু হয়নি। সবে আমরা রোল নম্বর লিখছি। সেটাও করতে হয় পেনসিলে ঘর ভর্তি করে। ওই উত্তরপত্রে একটা ঘর আছে, পরীক্ষার্থীর স্বাক্ষর। আমি স্বাক্ষর করলাম। একটু পরে ওই শিক্ষক এলেন, সবার খাতার ওপরে তিনি সই করবেন। আমার খাতা দেখে বললেন, ‘এই খাতা কম্পিউটারে দেখবে। কম্পিউটার বাংলা সাইন বোঝে না। আপনি বাংলায় সাইন করছেন কেন?’
আমি বললাম, সাইন মানে তো সাইন। এটা কোনো ভাষা নয়। আর কম্পিউটার এই সাইন রিড করবে না। কম্পিউটার যেটা রিড করবে, সেটা এই গোল্লা দেওয়া ঘরগুলো।
উনি বললেন, ‘আপনি ইংরেজিতে সাইন করেন।’
আমি বললাম, শোনেন, আমি বুয়েট থেকে পাস করেছি। কম্পিউটারের কোম্পানিতেও চাকরি করেছি। আপনাদের এই খাতাগুলো বুয়েটেই যাবে। আর ব্যাপার হলো, খাতা যদি বাতিল হয় আমার হবে। আপনার তো হবে না। আপনি নিজের কাজ করেন।
উনি বললেন, ‘না, আপনি বাংলায় সাইন করবেন কেন, কম্পিউটারে খাতা দেখবে, এটা অবশ্যই ইংরেজিতে করতে হবে।’
আমি বললাম, আমার একটাই সাইন। সেটা বাংলায়। আমি বিদেশে গেছি এই সাইন দিয়ে। সাইনের কোনো বাংলা ইংরাজি হয় না। আপনি দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন না। আপনি যান।
তিনি গলা চড়িয়ে বললেন, ‘আমি বলতেছি আপনে ইংরাজিতে সাইন করেন।’
আমিও গলা চড়িয়ে বললাম, আমি আপনাকে বলতেছি আপনি এখান থেকে সরেন। যান।
উনি আরও জোরে চিৎকার করে উঠলেন।
আমি ততোধিক জোরে চিৎকার করলাম।
উনি বলতে লাগলেন, ‘পুলিশ ডাকো, পুলিশ ডাকো। পরীক্ষার হলে বড় সন্ত্রাসী ঢুকে পড়েছে।’
ওই স্কুলের হেডমাস্টার চলে এলেন। পেছনে তিনজন রাইফেলধারী পুলিশ। তাঁরা এসেছেন সন্ত্রাস দমন করতে।
তাঁরা বললেন, ‘ইংরাজিতে সাইন করেন।’
আমি বললাম, করব না।
প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘কেন ভাই এই রকম করছেন। একটা সাইনই তো। ইংরাজিতে করলে কী হয়।’
তিনজন বন্দুকধারী বন্দুক বাগিয়ে বললেন, ‘ইংরাজিতে সাইন করেন। কম্পিউটার বাংলা সাইন বোঝে নাকি। করেন।’
আমি বললাম, আমার ইংরাজি সাইন নাই। আমি কী করব?
বন্দুক তিনটা একেবারে আমার মাথা বরাবর এগিয়ে আসছে।
তাঁরা জোর করে আমাকে দিয়ে ইংরাজিতে নাম লিখিয়ে নিয়ে গেলেন।
জানি না, কম্পিউটারবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল, জামিলুর রেজা চৌধুরী এবং মোহাম্মদ কায়কোবাদ এই লেখা পড়ছেন কি না। পড়লে অন্তত তাঁরা যে প্রাণভরে হাসছেন এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আপনিও হাসছেন? কী আর করা, আমিও হাসি তাহলে।
আনিসুল হক
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১৫, ২০১০
Leave a Reply