রাকিব কিশোর এর ভাবনার দূরবর্তী ছায়া অবলম্বনে লিখেছেন মহিউদ্দিন কাউসার
স্যার ক্লাসে ঢুকে LOL মার্কা একটা বিরাট হাসি দিয়ে বললেন, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এবার শিক্ষকদের পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদেরও ঈদ বোনাস দেওয়া হবে।
পুরো ক্লাস হইহই করে উঠল। স্যারের কমেন্টটাকে আমরা ১০০ ‘লাইক’ দিলাম। আমি এমনিতে কখনো স্যারদের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথাটথা বলি না। এবার বললাম।
—স্যার, দয়া করে যদি বলতেন ‘বোনাস’ হিসেবে আমাদের ঠিক কী দেওয়া হবে।
স্যার বললেন, আগে বললে তো মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে, তার পরও বলি, ১০টা অতিরিক্ত ক্লাস ।
মাথায় রীতিমতো হালকা বজ্রপাতসহ আকাশটাই ভেঙে পড়ল ।
সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নটাও ভেঙে গেল। স্বপ্ন এর চেয়ে আর কতই বা খারাপ হতে পারে! কষ্টেসৃষ্টে তাই আবারও ঘুমোতে গেলাম… ।
চোখ লাগতেই এবার মধুর একটা স্বপ্নের শুরু হচ্ছে বলে মনে হলো। দেখলাম, আমি ছাত্রলীগের একটা গ্রুপে জয়েন করেছি। আহ্, এবার আমাকে পায় কে! পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এখন আমার দুই আঙুলের চিমটিতে। ক্ষমতা, চাঁদা, টেন্ডার… । তখনি আবার আমার মাথার পেছনে ভালোবাসার একটি উষ্ণ স্পর্শ পেলাম সুইট স্বপ্নটি যেন ধারাবাহিক সাবান নাটকের (সোপ অপেরা) মতো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে ধীরে ধীরে পেছন ফিরে চাইলাম। আমার চোখ পুরাই ছানবড়া, বেগুনবড়া, আলুর চপ হয়ে গেল। এ তো দেখছি ছাত্রলীগের অন্য গ্রুপের কর্মী। উষ্ণ স্পর্শ নয়, সে আমাকে থাপ্পড় দিয়েছিল। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘ভাই, আমার কাছে কী চান?’ সে আমার স্ট্যাটাসে কোনো কমেন্ট না দিয়ে তার পাশের জনকে জিজ্ঞেস করল—
‘কী করমু, বস? দুই তলা থেকে উড়াইয়া ফালাইয়া দিমু?’
একজন পাতি নেতা বলল, ‘না না, ঈদ সামনে, ওরে একটা বোনাস দেওয়া যাক… ।’ আমি আশ্বস্ত হলাম। ভাবলাম, এই ঈদে বোধহয় আমি আমার পিতৃপ্রদত্ত জীবনটাই বোনাস পাচ্ছি। কর্মীটি বলল, ‘কী কন, বস? বোনাস?’
—h m m m…দুই তলা না, ওরে বোনাস হিসেবে চাইর তলা থেকে ফালাবি ।
আবারও ঘুম ভেঙে গেল। না বাপ, আমি আর ঈদ বোনাস চাই না। আমার অফ ডেতে আমি যে অফিসে পার্টটাইম জব করার পার্ট নিই, সেখানে গিয়েও আজ মেন্দা মেরে পড়ে থাকি। দুপুরের দিকে অফিসে ছোটখাটো একটা হুলস্থুল পড়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে আমিও নোটিফিকেশন পেলাম, অফিসে আজ ঈদ বোনাস দেওয়া হচ্ছে ‘ ’। বোনাসের কথা শুনেই আমি আঁতকে উঠলাম। গায়ে যে চিমটি কেটে দেখব স্বপ্ন কি না, তারও উপায় নেই। সকালেই নখ কেটে ফেলেছি। অগত্যা জায়গাতেই বসে রইলাম। বোনাস নিতে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না । অফিসে বসে কিছু একটা না করলে বেতনটা হালাল হবে কীভাবে? তাই কম্পিউটারের সামনে বসে ফেসবুকটা ওপেন করলাম। কী আকাশে-পাতালে । একটা নতুন মেসেজ এসেছে। সস্তা চায়নিজ মোবাইলেও মেসেজ এলে বিকট রিংটোন বাজতে থাকে।
অথচ আধুনিক ফেসবুকে মেসেজ এলে কিনা কোনো রিংটোন বাজে না! হায় সেলুকাস! অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে ফেসবুক ।
মিসেস জুকারবার্গকে বলতে হবে, তিনি যেন ফেসবুক মেসেজে রিংটোন দেওয়ার জন্য মি. জুকারবার্গকে দিনরাত জ্বালাতে থাকেন। যা-ই হোক, মেসেজটা খুললাম। বাল্যকালের বন্ধু ফাহাদের মেসেজ: ‘বন্ধু, তোর জন্য ঈদ গিফট পাঠাচ্ছি, রিসিভ করিস।’ আমার আনন্দ দেখে কে ? কী পাঠাতে পারে? অ্যাপলের ম্যাকবুক, আইফেস, আইপ্যাড, রোল্যাক্সের ঘড়ি, গেইম স্টেশন নয়তো? আনন্দটা চেপে ধরে, কম্পিউটারটা বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকি। অফিসের লোকজন একে একে বোনাস নিয়ে যার যার সিটে ফিরে আসছে। আমি স্প্রিংয়ের মতো লাফ দিয়ে উঠি। অফিস সত্যিই বোনাস দিচ্ছে, ইহা বাস্তব! এক দৌড় দিলাম অ্যাকাউন্ট সেকশনে। ঢুকতেই অ্যাকাউন্ট্যান্ট বলল—
‘অ্যাকাউন্টে ক্যাশমানি শেষ, বাকিদের বোনাস দেওয়া হবে ঈদের পর, ধন্যবাদ।’
আমি দুঃখ পাইনি। দুঃখ পাওয়ার সময় কই? আমার গিফট তো আসছে গ্রেট ব্রিটেন থেকে। আমি দুই টাকার গিফটের খ্যাতা পুড়ি।
বিকেলে বাসায় ফিরেই মাকে জিজ্ঞেস করি, ‘আমার নামে কোনো কুরিয়ার এসেছে?’ মা বললেন, ‘কই, না তো।’
আমি আবার ফেসবুক ওপেন করি। মেসেজ লিখি, ‘বন্ধু, তোর গিফট তো এখনো পাইনি।’
বাল্যকালের বন্ধু বলে কথা। জবাব দিতে একটুও দেরি করে না।
‘কেন? আমি তো দুপুরেই তোর ফেসবুক ওয়ালে গিফটগুলো পোস্ট করে দিয়েছি। না পেলে বল, আবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
মেজাজটাই খিঁচড়ে ওঠে। ইস! এই মেসেজটা যদি দুঃস্বপ্ন হতো। গায়ে চিমটি কেটে যে দেখব দুঃস্বপ্ন কি না, তারও উপায় নেই, সকালেই নখ কেটে ফেলেছি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ৩০, ২০১০
Leave a Reply