বাংলাদেশের আবহাওয়ার মতো ইদানীং বাবার মতিগতিও কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। প্রায়ই দেখি জ্যামে পড়া বাসের মতো ঝিম মেরে বসে থাকেন। আজ আবার খাতায় কী যেন লিখছেন। আমি শিওর, বাবা কেনাকাটার লিস্ট করছেন। এই সুযোগে আমার জন্য কত বরাদ্দ তা দেখা উচিত। প্রয়োজনে বাড়িওয়ালাদের মতো বিনা নোটিশে আমার বরাদ্দ টাকা বাড়ানোর দাবি তুলতে হবে। মনে একটা সংগ্রামী চেতনা নিয়ে বাবাকে বললাম,
বাবা, কী করছো?
একটা উপন্যাস লিখছি।
সর্বনাশ!
সর্বনাশ নয় গাধা, উপন্যাস। উপন্যাস কথাটা শুনিসনি আগে? তা শুনবি কেন? পড়ালেখার সঙ্গে তোর যে দূরত্ব, ঢাকা-কলকাতার দূরত্ব তার কাছে কিছু্ই না।
ঘটনা কিছুই বুঝলাম না। বাবা এত কথা বলছেন কেন? নিশ্চয়ই মন-মেজাজ ভালো। মন ভালো থাকলে বাবা বেশি কথা বলেন। আমি সাহস করে মনের কথাটা বলেই ফেললাম,
বাবা, আমাকে টাকা দেবে না?
এ্যা? কিসের টাকা বল তো? আমি কি তোর কাছ থেকে কোনো টাকা ধার করেছিলাম?
আরে ধার করবে কেন? জামা-কাপড় কেনার জন্য টাকা লাগবে। তা ছাড়া ঠিক করেছি বন্ধুরা মিলে বান্দরবান যাব।
তোর জামা কাপড় নেই?
ঈদে নতুন জামা কিনব না?
যা, তোর আপুকে ডেকে আন।
এর মধ্যে আবার আপু কেন? ও এলে আমার আর টাকা পাওয়া হবে না। ও ঠিকই বাবার সাইকোলজিটা বুঝে অ্যাকশন নেবে। সাইকোলজির ছাত্রী তো। তার পরও বাবার আদেশ বলে কথা। আপু এসেই নেতাদের মতো আবেগঘন গলায় বলল, ‘বাবা! চোখের নিচে কালি কেন? নিশ্চয়ই রাত জেগেছ। তোমাকে ডাক্তার রাত জাগতে নিষেধ করেছে না?’
বাবা বললেন, ‘বস, কথা আছে।’ আমি বাবার সামনের চেয়ারটায় বসলাম। আরও একটা চেয়ার খালি ছিল, আপু তাতে না বসে বাবার চেয়ারের হাতলে হেলান দিয়ে বসল। কী চালাক! আপু বলল, ‘বাবা, তুমি কেন ডেকেছ আমি জানি। ঈদে কী নেব তা জানার জন্য তো? আমার কিছু লাগবে না।’
আমি ভয়ানক অবাক হলাম। আপুর মুখে এই কথা শোভা পায় না। নিশ্চয়ই অন্য মতলব আছে। আমি বেঁচে থাকতে তা কিছুতেই হতে দিতে পারি না। আগ বাড়িয়ে বললাম,
তোর টাকা না লাগলেও আমার লাগবে। বান্দরবান যাব।
বান্দর দেখতে ওখানে যাওয়ার কী দরকার? আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখ না। বাসায় ভালো আয়না আছে। চায়নিজ জিনিস। তাতেও কাজ না হলে চিড়িয়াখানায় যা। প্রথম খাঁচাটাই বাঁদরের।
প্রচণ্ড রাগ লাগল। আমি ছাত্রলীগের কর্মী হলে এতক্ষণে আপুকে ধরে দোতলার ছাদ থেকে নিচে ফেলে দিতাম। কত বড় সাহস, আমাকে বাঁদর বলে! একটা উপযুক্ত জবাব দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু বাবা বললেন, ‘ওরে, তোরা থাম। আমি আমার উপন্যাসটা তোদের পড়ে শোনানোর জন্য ডেকেছি। শুনে বল কেমন হলো।’
আপু আবেগের ডোজ আরেকটু বাড়িয়ে বলল, ‘বাবা, কাল আমার ভয়ংকর একটা পরীক্ষা আছে, আমি পরে শুনব, এখন যাই।’
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোরও কি পরীক্ষা আছে?’ আমি হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লাম। বাবা হতাশ হয়ে বললেন, ‘কী যুগ এল। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও পরীক্ষা হয়। আচ্ছা, যা তোরা। গিয়ে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দে।’
ড্রাইভার আসতেই বাবা তাকে উপন্যাস পড়ে শোনাতে লাগলেন। আমি আড়াল থেকে দেখছি। বাবা বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। ড্রাইভার চাচার মনোযোগ আরও বেশি। গালে হাত দিয়ে পা নাচাতে নাচাতে শুনছেন। শুনতে শুনতে আমার কেমন যেন ঝিমুনি এসে পড়েছিল, হঠাৎ ইঞ্জিনের আওয়াজের মতো একটা আওয়াজ পেলাম। ভালোমত শুনে বুঝলাম চাচা ঘুমের মধ্যে নাক ডাকছেন। আমি সামনে এসে বাবার পড়া থামিয়ে বললাম, ‘বাবা, চাচা ঘুমাচ্ছেন।’ বাবা গর্জে উঠে বললেন,
বরকত! ঘুমাচ্ছ নাকি?
না স্যার, আমি কাহিনির গভীরে চইল্যা গেছিলাম। চক্ষু না বুজলে কাহিনির গভীরে যাওন যায় না। বাপ রে। কী কাহিনি শুনাইলেন, স্যার! চোখে পানি আসার মতো। কলিজায় গিয়া লাগে।
গাধাটা বলে কী? একটা হাসির উপন্যাস পড়ছি, চোখে পানি আসবে কেন?
অ। না, মানে হেইটাই তো কইলাম। হাসতে হাসতে চোখে পানি চইল্যা আইবে।
তুমি যাও। আর শোন, এত জোরে নাক ডাকবে না। বাড়ির সামনের গাছটায় আগে অনেক পাখি ছিল। আমার ধারণা, তোমার নাক ডাকার শব্দে এরা বাসা ছেড়ে পালিয়েছে।
বাবা আমার দিকে উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, পাশের বাসার জহিরকে এটা দিয়ে বলবি আমার সঙ্গে দেখা করতে। তোরা তো আমার প্রতিভার দামটা দিলি না। জহিরের পত্রিকায় এটা ছাপালে তখন সবাইকে দেখিয়ে বলবি, আমার বাপের উপন্যাস।
জহির ভাইকে জিনিসটা দিয়ে আমি বাসায় চলে এলাম। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। মানুষের বাবারা ছেলেদের চেক লিখে দেয়, জায়গা-জমি-বাড়ি লিখে দেয়। আর আমার বাবা লিখেছে উপন্যাস। তাও আবার নাম ছাড়া উপন্যাস।
বিকেলে জহির ভাই এসে হাজির। হন্তদন্ত হয়ে বাবাকে গিয়ে বললেন,
আংকেল! সামাজিক অসংগতি নিয়ে আপনি যা লিখেছেন তা পড়ে আমি মুগ্ধ। সত্যি, এমন ব্যতিক্রমী প্রবন্ধ আমি কখনোই পড়িনি। আমি শিওর, প্রমথ চৌধুরী চাইলেও এমন প্রবন্ধ লিখতে পারত না। কিন্তু আংকেল, আমার পত্রিকায় শুধু গল্প-উপন্যাস আর কবিতা ছাপি, প্রবন্ধ তো ছাপি না।’
—জহির, এটা প্রবন্ধ নয়, এটা একটা সামাজিক উপন্যাস।
জহির ভাই কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘সরি আংকেল। আসলে উপরে নাম লেখা নেই তো তাই বুঝতে পারিনি। তবে ভালো, বেশ ভালো। হয়েছে কি, আমাদের টানা ছয় সংখ্যার ম্যাটার একেবারে রেডি তো, তাই আপাতত ছাপতে পারছি না। যাই, আংকেল।’
রান্নাঘর থেকে মা এসে বললেন, ‘তুমি ভেবেছ কী? তোমার নাম মুহম্মদ জাফর ইকবাল হয়েছে বলেই তুমি উপন্যাস লিখতে পারবে? এত সহজ? শোনো, নামে মিল থাকলেই উপন্যাস লেখা যায় না। এক কাজ করো, তুমি সাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাসগুলো ভালোমতো পড়ো। তারপর লেখার চেষ্টা কোরো। না পড়ে লিখলে এমনই হবে। লিখবে উপন্যাস, হবে প্রবন্ধ। বুঝেছ?’
মায়ের কথা বাবা বুঝেছেন কি না জানি না, তবে তিনি আমার কাছ থেকে মুহম্মদ জাফর ইকবালের সব উপন্যাস নিয়ে বারান্দায় বসেছেন। কী অদ্ভুত! আমার বাবা মুহম্মদ জাফর ইকবাল পড়ছেন সাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস। দুজনের নামই এক। একজন লেখক, আরেকজন পাঠক। তবে পাঠক হিসেবে বাবা বেশ ভালো। একটু পড়েন, আর গলা ছেড়ে হেসে ওঠেন। তার হাসি শুনে আমরাও হাসি। ভালোই লাগে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ৩০, ২০১০
Leave a Reply