স্যারের নাম আবদুল বাতেন। তবে সবাই আড়ালে ডাকে ‘বেত-বাতেন’। কারণ স্যারের হাতে সব সময় একটা বেত থাকে। বেত মারায় তাঁর জুড়ি নেই। ছাত্ররা যমের মতো ভয় পায় এই বেত-বাতেন স্যারকে। সেই যমদূতের মতো বাতেন স্যার আজ সকালে বাসায় পেপারটা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন! এর মানে কী? সরকার আইন করেছে, এখন থেকে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীকে মারলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। কোনো মানে আছে? আরে একটা সময় ছিল ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ…! সেই যুগ আর নেই। এখন হচ্ছে ছাত্রনং মারনং তপঃ…! এটা অবশ্য বেত-বাতেন স্যারের নিজস্ব দর্শন। কিন্তু তাই বলে আইন করে তাঁর বেত মারা বন্ধ? তাহলে বেয়াড়া ছাত্ররা শিখবে কীভাবে?
বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতে বেত-বাতেন স্যারের রক্তচাপ বেড়ে যায় যেন। তার পরও তিনি বহু বছরের অভ্যাসের কারণেই হাতে বেত নিয়ে স্কুলের দিকে রওনা হলেন। আরে কত রকমের আইনই তো হয় এই দেশে…! এই তো, প্রকাশ্যে ধূমপানের ওপর আইন হয়েছে… কে মানে? রাস্তাঘাটে সমানে সবাই সিগারেট টানে!
বেত নিয়েই সরাসরি ক্লাসে ঢুকলেন বেত-বাতেন স্যার। তিনি ক্লাস টেনের শ্রেণীশিক্ষক, বিজ্ঞান পড়ান। আজ এনেছেন বড় বেতটা। বড় ক্লাসে সাধারণত বড় বেতটাই নিয়ে আসেন। সাধারণ বেত না, সিলেট থেকে আনানো ‘মুতরা বেত’! সিলেটের বিয়ানীবাজার এলাকায় কোথাও কোথাও পুকুরের আশপাশে এই বেত হয়। চিকন বলে এর শীতলপাটি দেশবিখ্যাত। বেত-বাতেন স্যার তাঁর এক ভায়রাকে দিয়ে বছরে দুইবার এই বেত আনান সিলেট থেকে। প্রতি শুক্রবারে তিনি নিজ হাতে এই বেতে সরষের তেল দিয়ে রোদে দেন।
‘স্যার, হেড স্যার সালাম দিছে।’ পিয়ন বলে।
ক্লাসে ঢুকতে যাবেন এ সময় বাধা। ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেন বেত-বাতেন স্যার। তিনি এই স্কুলের সবচেয়ে প্রবীণ শিক্ষক। তার ওপর স্কুলের সেক্রেটারি তাঁর আপন ভাগ্নে! আর তাঁকেই যখন-তখন এই তরুণ হেড মাস্টার সালাম দেন! এটা তাঁর পছন্দ নয়। তিনি কড়া গলায় বললেন, ‘যেয়ে বলো, ক্লাসের পরে যাব।’
ক্লাসে ঢুকে একটা ধাক্কা খেলেন বেত-বাতেন স্যার! তাঁর টেবিলের ওপর সেই পেপারটা, যেখানে বক্স নিউজ— ‘শিক্ষার্থীদের মারলে কঠিন সাজা’—খবরটা কেউ আবার লাল কালিতে দাগ দিয়ে রেখেছে। তিনি বসতে বসতে ছাত্রদের দিকে তাকালেন কঠিন দৃষ্টিতে। কিন্তু তাঁর মনে হলো, সবার মুখে যেন মিটিমিটি হাসি, আগের সেই ভয় মাখানো চেহারাগুলো নেই! তিনি পেপারটা সরিয়ে বেতটা রাখলেন। রোল-কলের খাতা বের করে খুলতে যাবেন, টের পেলেন, ছেলেরা সব ফিসফাস কথাবার্তা শুরু করেছে। কেউ কেউ চাপাস্বরে হাসছে! কত বড় সাহস! তাঁর ক্লাসে হাসি? তিনি বেত দিয়ে টেবিলের ওপর চটাস করে বাড়ি দিয়ে হুংকার ছাড়লেন, ‘একদম চুপ! টুঁ শব্দটি করা যাবে না!’ সবাই চুপ করে গেল, কিন্তু হঠাৎ কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘থ্রি…!’
‘এই, কে? কে চেঁচাল?’
‘স্যার, ওই যে আপনি বললেন, টুঁ শব্দ করা যাবে না…তাই থ্রি বললাম।’
বেত-বাতেন স্যার হতভম্ব হয়ে দেখেন, সবচেয়ে বেশি মেরে যাকে সুুখ পেতেন তিনি, সেই মোটাসোটা গোলগাল মুকিত দাঁড়িয়ে! সে-ই বলেছে। মুখটা হাসি-হাসি! এত সাহস! তিনি ডান হাতে শক্ত করে বেতটা নিয়ে উঠতে যাবেন মুকিতকে শায়েস্তা করতে, এ সময় আবার হেড সারের পিয়ন দরজায়, ‘স্যার, হেড স্যার বলছে জরুরি!’
বেত-বাতেন স্যারের ইচ্ছে হলো বেতটা উঠিয়ে আগে ঘা কতক পিয়নটাকে মারেন। কত বড় সাহস! বলেছেন, ক্লাসের পর যাচ্ছেন। তার পরও…!
কী মনে করে বেত-বাতেন স্যার রোল কল না করেই বেতটা ক্লাসে রেখে গেলেন হেড স্যারের রুমে।
হেড স্যার গম্ভীর মুখে বসে আছেন। বয়সে তরুণ হলেও ব্যক্তিত্ব আছে লোকটার। তাই বলে বেত-বাতেন স্যারের সঙ্গে…!
‘স্যার, বসেন।’ গম্ভীর গলায় বললেন হেড স্যার।
‘কী ব্যাপার?’
‘ব্যাপার সামান্যই। আজকের পেপার দেখেছেন বোধ হয়?’
‘দেখেছি।’
‘তার পরও ক্লাসে বেত নিয়ে ঢোকাটা আপনার ঠিক হয়নি। অনেক গার্জেন বিষয়টা আমার নজরে এনেছেন।’
মাথায় রক্ত উঠে যায় বেত-বাতেন স্যারের।
‘কোন কোন গার্জেন, নাম বলুন তো দেখি?’
‘মানে? আপনি তাদেরও শাসন করবেন নাকি?’ ভ্রু কুঁচকে গেছে হেড স্যারের, ‘দেখুন, বাতেন-স্যার, আপনি স্কুলের প্রবীণ শিক্ষক বলে এত দিন কিছু বলিনি। কিন্তু আপনার আচার-আচরণ শিক্ষকসুলভ নয়। এই স্কুলে আপনার হাতে আমি আর কখনো বেত দেখতে চাই না… যান, ক্লাসে যান।’
ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলেন বেত-বাতেন স্যার।
অনেকটা টলতে টলতে ক্লাসে ফিরে এলেন বেত-বাতেন স্যার। চেয়ারে বসে দেখেন, পেপারের ওপর রেখে যাওয়া বেতটা কেউ ভেঙে রেখেছে। অনেকটা ভি অক্ষরের মতো হয়ে আছে বেতটা। ভিক্টোরি? ছাত্রদের বিজয়? ছাত্ররা অবশ্য সব চুপ। হঠাৎ ভেতরে ভেতরে দুর্বল বোধ করেন বেত-বাতেন স্যার। রক্তচাপটা বাড়ল নাকি? আজ ক্লাসে বায়ুচাপ পড়ানোর কথা ছিল, কিন্তু চারদিকে অন্যান্য চাপ যেভাবে… আর ভাবতে পারেন না। কোনোমতে রোল কলটা করে ক্লাস না নিয়ে ভাঙা বেত আর খাতাপত্র রেখেই বের হয়ে গেলেন তিনি। বের হওয়া মাত্র ক্লাসের ভেতর একটা হুল্লোড় উঠল। কে একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘বেশ! বেশ! বেত-বাতেনের দিন শেষ!’
গেটের কাছে এক গার্জেনের সঙ্গে দেখা হলো। এই গার্জেন বেত-বাতেন স্যারকে দেখলেই বলতেন, ‘স্যার, হাড্ডি আমার, চামড়া আপনের! পোলাডারে মানুষ কইরা দিয়েন।’ আজ অবশ্য তাঁকে সালাম তো দূরে কথা, মনে হলো চিনতেই পারলেন না! সত্যি, কত গরু-গাধা পিটিয়ে মানুষ করেছেন বেত-বাতেন স্যার! আর এখন! ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই মানুষ না হওয়া তাঁর এক ছাত্রের বেমক্কা ধাক্কায় আছড়ে পড়লেন ফুটপাতে। বেওয়ারিশ গরুটা আরও দু-একজনকে ধাক্কা-গুঁতো দিয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৬, ২০১০
Leave a Reply