যারা আমাকে পছন্দ করে তারা অনেকেই দেখি ‘দেশপ্রেম’ ‘দেশের জন্য ভালোবাসা’—এ রকম বড় বড় জিনিস দিয়ে আমার দেশে ফিরে আসার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। আসলে ব্যাপারটা মোটেও সে রকম নয়। যত দিন বিদেশে ছিলাম তখন—আকাশ কালো করে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে, সেই বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে ঘ্যাঁঘো ঘ্যাঁঘো করে ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে—এ রকম একটা দৃশ্যের জন্য আমার সমস্ত শরীর আকুলি-বিকুলি করত। মাঝে মাঝে মনে হতো এই মুহূর্তে যদি দেশে ফিরে গিয়ে সেই আকাশ কালো করা মেঘ, ঝমঝম বৃষ্টি আর ব্যাঙের ডাক না শুনি তাহলে বুঝি আমার শরীরে খিঁচুনি শুরু হয়ে যাবে, আমি দম বন্ধ হয়ে মরেই যাব। কাজেই একদিন বাক্সপেটরা বেঁধে দেশে চলে এসেছি। অবশ্য আমি আসতে পেরেছি কারণ আমার স্ত্রীও আসতে চেয়েছে। আমাদের দেশে মেয়েদের নানাভাবে যন্ত্রণা দেওয়া হয়, কাজেই একজন মেয়ে যখন ইউরোপ কিংবা আমেরিকার মতো দেশে যায়, হঠাৎ করে তারা আবিষ্কার করে সেখানে তারা স্বাধীন একটা মানুষের মতো থাকতে পারে, তখন তারা আর দেশে ফিরে আসতে চায় না। কিন্তু আমার স্ত্রী আসতে আপত্তি করেনি। তাই একদিন আমরা বাক্সপেটরা বেঁধে দেশে চলে আসতে পেরেছি। আমার মতো আরও অনেকেই আসতে চায়, কিন্তু সবাই আসতে পারে না।
আমার স্ত্রী আর আমি নিজের দেশে ফিরে এসেছিলাম, কিন্তু আমার ছেলে আর মেয়ে কিন্তু এসেছিল বিদেশে। তাদের জন্ম হয়েছিল আমেরিকায়, বড় হয়েছে সেখানে, বন্ধুবান্ধব সেখানে; কাজেই বাংলাদেশটি তাদের জন্য ছিল বিদেশ। প্রথম প্রথম অভ্যস্ত হতে তাদের খুব কষ্ট করতে হয়েছে; সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল স্কুলগুলো। তারা আমেরিকাতে যেসব স্কুলে পড়ে এসেছে সেখানে বাচ্চারা যেন আনন্দে থাকতে পারে তার জন্য স্কুলের শিক্ষক-কর্মকর্তা সবাই জান দিয়ে চেষ্টা করেন। এখানে এসে তারা আবিষ্কার করল, স্কুলে শিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রীদের বেত দিয়ে মারে—নিজের চোখে দেখেও তাদের বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয়েছে। আমার খুব ভয় ছিল যে কোনো দিন শিক্ষকেরা আমার ছেলে কিংবা মেয়েকে মেরে বসবে—সে জন্য দুজনকেই আমি একটা চিঠি লিখে খামে ভরে দিয়েছিলাম। তাদের বলে দিয়েছিলাম, যদি কখনো কোনো শিক্ষক তাদের গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকের হাতে এই চিঠিটা দিয়ে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে স্কুলের গেটের বাইরে চলে আসবে। চিঠিতে আমি লিখে দিয়েছিলাম, ‘আপনারা যেহেতু আমার সন্তানের গায়ে হাত দিতে উদ্যত হয়েছেন, সে জন্য এই মুহূর্তে আমি তাকে আপনাদের স্কুল থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। সে আর আপনাদের স্কুলের ছাত্র না। তার গায়ে আপনারা আর হাত দিতে পারবেন না।’
আমার ছেলে আর মেয়ে অনেক দিন পর আমাদের জানিয়েছিল যে তারা যত দিন ওই ভয়ংকর স্কুলগুলোতে ছিল, তত দিন প্রাণপণ চেষ্টা করেছে শিক্ষকদের কোনো না কোনোভাবে রাগিয়ে দিতে, যেন তারা গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করে, তাহলেই তারা শিক্ষকদের হাতে ওই চিঠিগুলো দিয়ে বের হয়ে আসতে পারবে। আর কোনো দিন তাহলে স্কুলে যেতে হবে না। কী মজা হবে তখন!
শিক্ষকেরা ব্যাপারটা নিশ্চয়ই অনুমান করেছিলেন, তাঁরা অন্য ছাত্রদের পিটিয়ে লাশ বানিয়ে দিলেও কোনো দিন আমার ছেলেমেয়ের গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করেননি।
[লেখাটি লেখকের তোমাদের প্রশ্ন আমার উত্তর বই থেকে সংগৃহীত]
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৬, ২০১০
Leave a Reply