আহা, কী সময়টাই না ছিল তখন! মেয়েরা হাতপাখা তৈরি করে রঙিন সুতা দিয়ে ‘ভুলো না আমায়’ বা ‘যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে’—এই টাইপের কথা লিখত। সন্ধ্যাবেলায় কুপি বা হারিকেনের আলোয় বাচ্চারা মাথা দুলিয়ে পড়ত, ‘রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে…।’ পড়তে পড়তে গলা শুকিয়ে গেলে মাটির কলস থেকে পান করত ঠান্ডা পানি। বাড়ির উঠোনে বসত গল্প বা পুঁথিপাঠের আসর। লাইলি-মজনুর দুঃখে দুঃখিত হয়ে গ্লিসারিন ছাড়াই সবার চোখে চলে আসত পানি। আহ! কী আবেগ, কী তীব্র ভালোবাসা! কিন্তু হায়, সেই দিন কি আর আছে? আমরা আমাদের ঐতিহ্য, শেকড়ের টান উপেক্ষা করেছি। পদ্মা-মেঘনার উত্তাল স্রোতে গা না ভাসিয়ে গা ভাসিয়েছি বিদেশি সংস্কৃতির ভয়াল স্রোতে। কোথাকার কোন এডিসনের কথামতো ঘরে নিয়ে এসেছি বিদ্যুৎ নামের অভিশাপ। এই বিদ্যুৎ আমাদের সব ঐতিহ্য শেষ করে দিচ্ছে। সেই স্নেহ (চর্বি নয়) মাখা হাতপাখা, হারিকেনের জায়গা কেড়ে নিয়েছে বৈদ্যুতিক বাতি, ফ্যান। ফলে দিন দিন আমরা আরও অলস হয়ে যাচ্ছি। হাতপাখা দিয়ে বাতাস করলে ব্যায়াম হতো, হারিকেনের তেল শেষ হয়ে গেলে বাজার থেকে তেল আনতে গিয়ে আরও ভালো ব্যায়াম হতো। এখন কিছুই হয় না। সুইচ টিপলেই বাতি জ্বলে, মাথার ওপর বৈদ্যুতিক পাখা ঘোরে। ফলে আমাদের কায়িক পরিশ্রমও হচ্ছে না। কী ভয়ংকর সমস্যা! এত বড় সমস্যা হবে আর আমাদের সরকার ঝিম মেরে বসে থাকবে, তা তো হয় না। জনগণের দুঃখ লাথি মেরে সরিয়ে দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। আর তাই এই সব হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে তারা লোডশেডিংয়ের মতো চমৎকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিছুক্ষণ পরপর ওই অভিশপ্ত বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে সরকার সবাইকে হাতপাখা, হারিকেন, মোমবাতির যুগে ফিরিয়ে নিচ্ছে। চমৎকার উদ্যোগ। কিন্তু একটি চক্রান্তকারী মহল সরকারের এই কাজে ক্ষিপ্ত হয়ে বাধা দিচ্ছে। তবে এসব কোনো ব্যাপার নয়, ভালো কাজে বাধা আসবেই। আশা করি, সরকার সব বাধা ডিঙিয়ে আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত সময়টি ফিরিয়ে দেবে। সেই দিন বেশি দূরে নয়।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৬, ২০১০
Leave a Reply