অসংখ্য গাড়ির চাকার দাগ বসে যাওয়া, ধূলিময় পথে ছুটছিল একটা চকচকে মার্সিডিজ। গাড়ির মেঝেতে সৃষ্টি হওয়া ফুটোটার ভেতর দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে বাঁ পা ঝোলাতে ঝোলাতে দাঁত কেলিয়ে গাড়িটা চালাচ্ছিল ড্রাইভার। এত সুন্দর গাড়িটাতে এমন একটা ফুটো কীভাবে হলো সে রীতিমতো এক রহস্য। উইন্ডস্ক্রিনটাও গত রাতে চুরি গেছে। তবে এ নিয়ে তার তেমন মাথাব্যথা নেই। শুধু কোনো এক নির্জন পার্কিংয়ে গিয়ে মোটামুটি ওই মাপের একটা কিছু খুঁজে বের করতে পারলেই হলো, ব্যস।
মরা একটা নদী পার হতে গিয়ে গাড়িটা বেশ একটা ঝাঁকি খেল আর সেই সঙ্গে গাড়ির এগজস্টটা টুং করে খুলে পড়ল। ভাগ্যক্রমে গাড়ির মালিক ওয়াঙ্গা তখন জ্যানেট ও জন এর লেখা সাংবাদিকতার নিয়ম-কানুন নামের বইটিতে ডুবে ছিলেন। তাই শব্দের দিকে খেয়াল করলেন না।
আরও কিছুক্ষণ ঝাঁকি খাওয়ার পর গাড়ি থামল একটি অফিসের সামনে। ওয়াঙ্গা গাড়ি থেকে নেমেই ড্রাইভারকে ‘তোর চাকরি শেষ’ বলে অফিসে ঢুকে পড়লেন।
সম্পাদক সাহেব চলে এসেছিলেন ইতিমধ্যে। জিজ্ঞেস করলেন, নতুন খবর কী কী?
‘দারুণ খবর বস। এক লোক একটি সিংহকে কামড়েছে।’ গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন রিপোর্টার ওয়াঙ্গা।
এ রকম একটা খবর সম্পাদক আগেই পড়েছিলেন। তাই তিনি বললেন, ‘আরও বলো।’
‘সিংহটাকে মমি বানিয়ে রাখা হয়েছে।’
‘তোমার কি মনে হয় এসব ফালতু খবরে আমার কাগজের কাটতি বাড়বে?’ চেঁচিয়ে উঠলেন সম্পাদক। ‘আমি চাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর। আগ্নেয়গিরি, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস এসবের খবর, পাহাড়ে প্লেন আছড়ে পড়ছে, তীর্থযাত্রীসহ ট্রেন ঝাঁপিয়ে পড়ছে, আকাশছোঁয়া দালানের ছাদে আটকে পড়ে মানুষ চিৎকার করছে এমন খবর। জোড়া যমজ, তিন মাথাওয়ালা ছাগল জন্ম নিচ্ছে, আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে টিকটিকি—এসব। আমার চাই মহামারি। দুর্নীতি। যুদ্ধ। খুন। আমার চাই স্কুপ।’
নিউজ ডেস্কের আশপাশের পরিবেশ রীতিমতো থমথমে। হঠাৎই কে যেন বাইরে থেকে জোরে জোরে দরজায় আঘাত করতে লাগল। ভয়ে ভয়ে দরজা খুললেন ওয়াঙ্গা। হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকল তার ড্রাইভার, পুরো শরীর ঘামে ভেজা। ‘বস, গরম খবর আছে।’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ড্রাইভার।
‘হুহ! তুই আবার কী খবর দিবি?’ অবজ্ঞার সুরে বললেন ওয়াঙ্গা।
এক নিঃশ্বাসে বলতে শুরু করল ড্রাইভার, ‘আমি পার্লামেন্টের পার্কিং লটের সামনে ঘোরাঘুরি করছিলাম। ভাবছিলাম আমাদের গাড়িটার জন্য কিছু যন্ত্রপাতি হাতানো যায় কি না। হঠাৎ দেখলাম বড়, সবুজ একটা গাড়ি। আমার স্ক্রু ড্রাইভার আর রেতি নিয়ে কাজে লেগে গেলাম। উইন্ডস্ক্রিনটা খুলতেই ভেতরে কিছু একটা দেখতে পেলাম।’
সম্পাদকের চোখেমুখে আগ্রহ ফুটে উঠল। ‘বলতে থাকো’—উত্তেজিত সম্পাদক বললেন।
‘সামনের সিটে ছিল বিশাল কাগজপত্রের স্তূপ। যা দেখলাম! নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিছু নিয়ে এসেছি।’
বলতে বলতে বাদামি রঙের একটা ফাইল সম্পাদকের দিকে এগিয়ে দিল ড্রাইভার।
‘কী এটা?’
‘জিম্বাবুয়ে টোব্যাকো গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন লন্ডন টাইমস পত্রিকা কিনে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। ইয়ান স্মিথ হবেন সম্পাদক, বিশপ আবেল মুজোরেওয়া থাকবেন স্পোর্টস ডেস্কের দায়িত্বে আর টেরোরিস্ট পেজটা দেখবেন রেভ সিথল। পুরো পত্রিকায় থাকবে খবর, গসিপ আর গেরিলাদের জন্য প্রয়োজনীয় টিপস। এই যেমন ধরুন, মুখে গ্রেনেড নিয়ে ধরা না পড়ে কীভাবে পুলিশ চেক পয়েন্ট পার হওয়া যায়—এসব। আরও একজন রিপোর্টার থাকবেন। তিনি সপ্তাহে তিন দিন জিম্বাবুয়ে টোব্যাকোর গুণাগুণ সম্পর্কে ধারালো সব প্রতিবেদন লিখবেন।’
‘স্যার, ভালো হয়েছে? আমাকে কি আবার রাখবেন স্যার?’ আমতা আমতা করে বলল ড্রাইভার।
‘অনেক ভালো কাজ করেছ তুমি। এ রকম সাহসী লোকই তো আমার চাই। তোমাকে আবার আমি রাখব। কিন্তু নতুন চাকরিতে। আজ থেকে তুমি নিউজ ডেস্কের দায়িত্বে থাকবে।’ বললেন সম্পাদক।
‘আমার কী হবে স্যার?’ বলে উঠলেন রিপোর্টার ওয়াঙ্গা।
তার দিকে সরু চোখে তাকালেন সম্পাদক। বললেন, ‘আপনি ড্রাইভিং জানেন মি. ওয়াঙ্গা?’
‘অবশ্যই স্যার। বিশ বছর ধরে আমার গাড়িটা তো আমিই চালাচ্ছি।’
‘তাহলে আজ থেকে আপনি আমার নতুন ড্রাইভার। আমার সঙ্গে আসুন। পার্লামেন্টে যেতে হবে।’
দুজন বেরিয়ে গেলেন অফিস থেকে। অফিসের ভেতর থেকে হতবাক রিপোর্টাররা শুনতে পেলেন বাইরে একটা মার্সিডিজ চালু হলো, তারপর যেন উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছুক্ষণ নড়াচড়া করল, তারপর রীতিমতো তাল হারিয়ে, গুলি ছোড়ার মতো ভটভট আওয়াজ করতে করতে চলে গেল।
অনুবাদ: আলিয়া রিফাত
আলেক্সান্ডার ফ্র্যাটার: ব্রিটিশ সংবাদিক ও লেখক। মূলত ভ্রমণ লেখক।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ০৭, ২০১০
Leave a Reply