হরিণনামা ২৪১০
২ আগস্ট ২৪১০, হরিণনগর (ঢাকা)
হরিণ আমাদের প্রধান গৃহপালিত পশু। এর চারটি পা, ছোট্ট একখানা লেজ ও দুটি কান আছে। মাথার ওপর আছে ডালপালা মেলে দেওয়া শিং। মাথার দুই পাশে কানের ঠিক নিচে আছে দুটি পটোলচেরা চোখ। তবে হরিণ যখন বন্য প্রাণী ছিল, তখন তাদের চোখ আরও সুন্দর ছিল। তখনকার কবি-সাহিত্যিকেরা সৌন্দর্য বর্ণনায় মানবীর চোখের তুলনা করতেন এই হরিণের চোখের সঙ্গে। হয়তো তখন পুরুষেরা নিজেদের বাঘ মনে করতেন এবং নারীদের তাঁরা নিরীহ-আতঙ্কিত-সলজ্জ দেখতে পছন্দ করতেন। হরিণের চোখের মধ্যে তাঁরা এসব কিছুর সংমিশ্রণ খুঁজে পেতেন।
হরিণ যেভাবে আমাদের হলো
৪০০ বছর আগের কথা। হরিণ তখন বনে বাস করত। ২০১০ সালে মনুষ্য প্রজাতির এক সরকার বনের হরিণ ঘরে পালনের মহান আইন করে। হরিণ পালন নিয়ে তখন অনেক মজার মজার ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমে সংখ্যায় ১০টি পর্যন্ত নিয়ে ব্যক্তি এবং দশের বেশি নিয়ে খামার পর্যায়ে হরিণ পালন শুরু হয়। এখন যে কেউ সামর্থ্য অনুযায়ী যত খুশি হরিণ পালন করতে পারে। তবে শুরুতে আইন অনুযায়ী বন বিভাগ ও চিড়িয়াখানা থেকে অনুমতি নিয়ে হরিণ পালন করতে হতো। হরিণ পশু হলেও বনে থাকত বলে তারা বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল। তখনকার বন মন্ত্রণালয় এখন ঐতিহ্য সংরক্ষণ মন্ত্রণালয়। বর্তমানে বন না থাকায় তাদের এই রূপান্তর।
এরও এক মজার ইতিহাস আছে। ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, বন থেকে হরিণ ঘরে চলে আসার পর বাঘের খাদ্যসংকট দেখা দেয়। বাঘেরা খাদ্যের খোঁজে বনের গভীর থেকে গভীরে চলে যেতে থাকে। এই সুযোগে মানুষ নির্বিঘ্নে বনের গাছ কাটা শুরু করে। গাছ কাটতে কাটতে একসময় বন উজাড় হয়ে যায় এবং বেঁচে থাকা দুর্ভিক্ষপীড়িত স্বল্পসংখ্যক বাঘ লোকালয়ে এসে মানুষ শিকার করতে শুরু করে। এতে আরেক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। বাঘের এই তৎপরতা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কাকতালীয়ভাবে বিরাট ভূমিকা রেখে ফেলে। এ জন্য ২০০ বছর আগে প্রথা ভেঙে তখনকার বন মন্ত্রণালয়কে জনসংখ্যা পুরস্কার দেওয়া হয়। কারণ তারা একটিমাত্র আইন করে বনের বাঘ থেকে শুরু করে বন্য প্রাণী ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি দারুণভাবে ঠেকিয়ে দেয়। তখনকার জামানার খাদ্যসংকট বিবেচনায় (বন্য প্রাণী ও মানুষ দুটোরই) ওটা ছিল এক ঐতিহাসিক কাজ। অবশ্য আমাদের পূর্বপুরুষেরা ঐতিহাসিক বলে বিবেচিত না হলে কোনো কাজই করতেন না। এ জন্য এক হাজার বছর আগেই বাঙালি অলস জাতির তকমা পায়।
আজ ৪০০ বছর পর এসে তখনকার তীব্র সমালোচিত বন আইন এখন ঐতিহাসিক ঠেকছে। কী দূরদর্শী ছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা!
হরিণ আমাদের যেসব কাজে লাগে
হরিণ আমাদের অনেক কাজে লাগে। আমরা হরিণ দিয়ে হাল চাষ করি। হরিণ থেকে আমরা মাংস ও দুধ পাই। হরিণকে ছাগলের সঙ্গে ক্রসব্রিডিং করে আমরা ছারিণ এবং গরুর সঙ্গে ক্রসবিডিং করে গরিণ নামে দুটি নতুন প্রজাতি উদ্ভাবন করেছি। তবে বৈজ্ঞানিক ত্রুটির কারণে ছারিণ ও গরিণের দুধ ও মাংস খাওয়া যায় না। এরা হাল চাষেরও উপযোগী নয়। প্রায় ১০০ বছর আগে গরু এবং ছাগল বিলুপ্ত হওয়ায় এখন আমাদের শুধু হরিণের মাংসই খেতে হয়।
হরিণের শিং আমরা আলনা হিসেবে ব্যবহার করি। এটা আমাদের বাসস্থানের ইনটেরিয়র ডিজাইনে অন্য রকম পরিবর্তন এনেছে। হরিণের চামড়া আমরা মূল্যবান লুঙ্গি ও স্কার্ট হিসেবে ব্যবহার করি। হরিণের শিং দিয়ে আমরা কান চুলকাই। এতে আমাদের কানের ছ্যাঁদা বড় হয় এবং আমরা ফিসফিস করে বলা কথাও সহজে শুনতে পাই। শ্রবণবিজ্ঞানে হরিণের শিংয়ের অবদান অপরিসীম।
আলোর পেছনে কালো সময়
সব মহৎ কাজের পেছনেই কারও না কারও চরম ত্যাগ থাকে। সে যুগে হরিণ পালন অবৈধ ছিল। কিন্তু কিছু অগ্রসর চিন্তার লোক সবকিছু তুচ্ছ করে গোচরে-অগোচরে হরিণ পালন করেছেন। তবে এর জন্য তাঁদের জেল-জরিমানা ভোগ করতে হয়েছে। সে এক অবর্ণনীয় কষ্টের সময় ছিল। তখন আইন প্রয়োগকারীরা ছিল বর্বর।
তখনকার দিনের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব (বর্তমান জামানায় এমন পদ নেই) হারিছ চৌধুরী, তাঁর আরেক রাজনৈতিক সচিব ও সাংসদ মোসাদ্দেক আলী ফালু, খুলনার মনিরুল হক টুটুল, ফরিদপুর কোতোয়ালি থানা বিএনপির সভাপতি ও ডিক্রিরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাদেকুজ্জামান মিলন পাল ও কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি খলিফা কামাল, বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ার, চাঁদপুরের ব্যবসায়ী শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক, জামালপুরের সরিষাবাড়ীর ফয়েজুল কবীর তালুকদার শাহীন, রংপুরে রহিম উদ্দিন ভরসা হরিণ পালন করার অভিযোগে মামলা খেয়েছেন, জেল খেটেছেন। অবশ্য তিন বছর পরই সেই হরিণান্ধকার সময়ের অবসান ঘটিয়েছে পরবর্তী সরকার। তারা বছরে মাত্র ১০০ টাকা (বর্তমানের এক পাই) পজেশন ফি নিয়ে হরিণ পালনকে বৈধতা দেয়। মারহাবা, মারহাবা!
একটি ঐতিহাসিক প্রস্তাব
আজ এই লেখায় আমি মহামান্য সরকারকে সাবেক বন ও বর্তমানের ঐতিহ্য সংরক্ষণ মন্ত্রণালয়কে ‘বনসংখ্যা’ পুরস্কার দেওয়ার জন্য প্রস্তাব করছি। কারণ তারা একটিমাত্র আইন করে বন, জন ও প্রাণসংখ্যা চমৎকারভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। ৪০০ বছর আগের এক অন্ধকার যুগে তারা এমন আলোকিত সিদ্ধান্ত কীভাবে নিল, তা নিয়েও গবেষণা হতে পারে। এই প্রসঙ্গে আমি একটি নতুন আইন করার প্রস্তাব করছি। বর্তমানে আমাদের পরম সাংসারিক সঙ্গী হরিণদের কোনো নাম নেই। অথচ তারা আমাদের নানা কাজে আসছে। তাদেরকে আর এই গণনামে ডাকা ঠিক হবে না। প্রস্তাব করছি, এখন থেকে হরিণের জন্মনিবন্ধন করতে হবে এবং প্রতিটি হরিণের নাম রাখতে হবে। নাম রাখার ক্ষেত্রেও একটা নিয়ম মানতে হবে। প্রথমে এর জন্য একটা গবেষণা সেল করতে হবে। ৪০০ বছর আগে কারা এই আইন করার উদ্যোগ নিয়েছিল, কারা কারা এই আইন তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিল, কারা এই আইন সমর্থন করেছে, আইনের পক্ষে ভোট দিয়েছে—শুরুতে তাদের নামে হরিণদের নামকরণ করতে হবে। বাকি ওপরওয়ালার মর্জি!
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ০২, ২০১০
Leave a Reply