ছোট মামাকে একটু আগে ‘নিউ লাইফ নার্সিং হোম’ থেকে আনা হয়েছে। সারা শরীরে কমবেশি ২৫-৩০টি সেলাই পড়েছে। বরাত ভালো, বেঁচে গেছেন। ঘটনা যেদিকে মোড় নিয়েছিল, যেকোনো অঘটন ঘটে যেতে পারত। হয়েছে কী, প্রতিবছরের মতো এবারও চণ্ডীপুর গ্রামে নবারুণ সংঘের পরিচালনায় প্রাইমারি স্কুল মাঠে গ্রাম্য ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আসর বসেছে। প্রতিবছর সরস্বতী পূজার পরের দিন এই আসর বসে। মাঠ ছোট। ক্লাবকর্তাদের ইচ্ছা থাকলেও ভালো কিছু করার সুযোগ নেই। লজেন্স-দৌড়, অঙ্ক-দৌড়, সুচে সুতা পরানো, চামচ মার্বেল দৌড়, মিউজিক্যাল চেয়ার, হাঁড়িভাঙা, রূপসজ্জার মধ্যেই কর্মকর্তাদের থেমে থাকতে হয়।
আসলে নবারুণ সংঘের এটা একটা বার্ষিক মিলনোৎসব। এখানকার জনপ্রিয় ইভেন্ট হলো রূপসজ্জা। এ ইভেন্টের আকর্ষণে দুপুরের পর স্কুলমাঠ সব বয়সের মানুষের ভিড়ে কানায় কানায় ভরে ওঠে।
নান্টু মামা ভীষণ একরোখা, ডানপিটে। হুটহাট এটা-ওটা করে বসেন। মাঠে পৌঁছেই মামা বললেন, ‘নোটোন, রূপসজ্জায় নাম দেব।’ বলেই হনহন করে যেখানে নাম নেওয়া হচ্ছে সেখানে গিয়ে হাজির। অন্যান্য ইভেন্টের নাম নেওয়া অনেক আগে শেষ হয়ে গেলেও হাঁড়িভাঙা এবং রূপসজ্জার নাম তখনো নেওয়া চলছে। নাম এন্ট্রি করে চেস্ট নম্বর পেলেন ৪২০। নম্বরটা হাতে পেয়ে মামা আপন মনে একটু নাড়াচাড়া করলেন। তারপর ঠিক আছে এমন ভাব করে কাগজটাকে চার ভাঁজ করে বুকপকেটে রেখে নির্বিকার চিত্তে মাঠের এক কোণে এসে দাঁড়ালেন।
এখান থেকে স্লো-সাইকেল রেস বেশ ভালো দেখা যাচ্ছে। দাঁড়াতেই মামাকে বললাম, ‘কী গো, নাম দেবে, তা তো আগে বলোনি। আর নাম তো দিলে, কিন্তু কী সাজবে, কখন সাজবে, তা তো কিছু বলছ না।’
মামা যেন শুনতেই পেলেন না আমার কথা। আমার উৎকণ্ঠার কোনো গুরুত্ব না দিয়ে যেমন তাকিয়ে ছিলেন, তেমনিই রইলেন। প্রাইজ পাওয়া না-পাওয়া অন্য কথা। কিন্তু একটা পরিকল্পনা তো থাকবে। একটা আয়োজন তো থাকেই। নিদেনপক্ষে কী সাজাবে আমাকে তো বলবে। কিন্তু আমি ছটফট করলেও মামা কিছু বলছেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে খেলা দেখছেন।
মিউজিক্যাল চেয়ার যখন শেষের দিকে, তখন ছয়টা চেনা মুখ আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। এদের সবার নাম না জানলেও মুখ চিনি। মামাদের গ্রামে থাকে। সবাই আমাদের চেয়ে বয়সে বড়। একজন অনির্বাণ ক্লাবের সেক্রেটারি। সুনির্মল মামা। সুনির্মল মামা মামাকে বলল, কী রে, নাম দিয়েছিস তো? আমরা কিন্তু রেডি।’
মামা ঝলমল করে উঠলেন। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে আর বলতে। এসেই নাম এন্ট্রি করেছি। এই যে চেস্ট নম্বর।’ বলেই বুকপকেট থেকে আলতা দিয়ে লেখা সাদা আয়তাকার কাগজ বের করে সবার সামনে ধরল।
নম্বর দেখে, সবাই হো হো করে হেসে উঠল। বাদল মামা মন্তব্য করল, ‘বাহ্, তোর ইভেন্টের সঙ্গে নম্বরটাও মানানসই হয়েছে দেখছি।’
রূপসজ্জার নাম দিয়েছে, তাতে ফোরটোয়েন্টির সঙ্গে কী সম্পর্ক বুঝতে না পেরে বোকার মতো এর-ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। কিন্তু কোনো প্রশ্ন করলাম না।
মামা বললেন, ‘সাবধানে ব্যাপারটা করো কিন্তু দেখো। হিতে বিপরীত যেন না হয়ে যায়।’ শ্যামল মামা বলল, ‘না, না, সে তোকে ভাবতে হবে না। আমরা মিছিমিছিই হাত চালাব।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘আমরা তাহলে মাঝপথেই ঢুকব, কী বলিস?’
‘হ্যাঁ, বিচারকেরা মাঠে ঢুকে পড়ার বেশ কিছুক্ষণ পর।’ মামা বেশ গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন।
যাক, বাঁচা গেল। ব্যাপারটা তাহলে হঠাৎই নয়। একটা পরিকল্পনা যে আছে, এখন তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
মিউজিক্যাল চেয়ার শেষ হতেই মাঠ বড় করে দেওয়ার জন্য ভলেন্টিয়ারসদের কাছে নির্দেশ এল। রূপসজ্জা হবে। বলতে বলতেই মাইকে ঘোষণা, ‘যারা রূপসজ্জায় নাম দিয়েছেন, তাঁরা অবিলম্বে মাঠে নেমে পড়ুন।’
চোখের পলকে প্রতিযোগীর দল স্কুলমাঠের অনেক অংশ ভরিয়ে ফেলল। হ্যাঁ, তা জনা চল্লিশেক হবে। কিন্তু মন দিয়ে যে একটু দেখব, তা আর পারছি কই। মামাদের চিন্তা আমাকে পেয়ে বসছে। মনে মনে ভাবলাম, দূর ছাই, অন্য কারও সঙ্গে যদি আসতাম, তো ভালোভাবে দেখতে পারতাম।
কজন বেশ সুন্দর সেজেছেও। গায়ে কাদা লেপে একজন সরস্বতীর ভঙ্গিমায় হাতে বীণা নিয়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু এ মুহূর্তে সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মের ওপর। সত্যি, ছেলেটা সেজেছে বটে। পটে আঁকা ছবির মতো তীরের ওপর টানটান হয়ে শুয়ে আছে। না, একটুও নড়চড় নেই।
কাগজ-কলম নিয়ে বিচারকেরাও মাঠের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। দেখছি আর তাজ্জব বনে যাচ্ছি বিটকেল ছোট মামার বুদ্ধি দেখে। দেখি তখনো দাঁড়িয়ে। ভেবে তো কূলকিনারাই পাচ্ছি না। সাজবেটা কখন, আর নামবেই বা কখন।
এসব ভাবছি, ঠিক তখনই শ্যামল মামাদের গলা। মামারা চোর চোর বলে চিৎকার করতেই ছোট মামা ছুটে মাঠের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। আর শ্যামল মামারা ছোট মামার পিছু পিছু মাঠের মধ্যে ঢুকে হিন্দি সিনেমার কায়দায় কিল, লাথি, ছুড়তে লাগল মামাকে তাক করে।
তারপর? তারপর সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড। শত শত লোক কিল, ঘুষি, চড় উঁচিয়ে মামার দিকে ধেয়ে গেল। কেউ কেউ আবার মাঠের আশপাশে পড়ে থাকা ছোটখাটো বাঁশের লাঠি নিতেও ছাড়ল না। ভয়ে তো আমার ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ। কী করব, কী করা উচিত, কিছুই বুঝতে পারছি না। কোনো মামাকেই আর দেখা যাচ্ছে না। জটলার মধ্যে থেকে শুধুই হুঙ্কার আসছে। ‘মার, মেরে শেষ করে ফেল… এই দিনদুপুরে এত লোকের মাঝেও…।’
কী করি বুঝতে পারছি না। কিন্তু কিছু একটা করতেই হবে। না হলে মামাকে বাঁচানো যাবে না। ঝাঁ করে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ছুটে গেলাম স্টেজের কাছে। সেখান থেকে মাইকে ঘোষণা হচ্ছিল। আঁকুপাঁকু করতে করতে বললাম, ‘এই যে শুনছেন। যাকে চোর বলে এত লোক মারতে উদ্যত হয়েছে, সে আসলে চোর নয়। আমার মামা। রূপসজ্জায় নাম নিয়ে চোর ভূমিকায় মাঠের মধ্যে নেমেছেন। প্রথমে যারা মামার দিকে তেড়ে গেল, সে ব্যাপারটাও আগে থেকে সাজানো। দোহাই আপনাদের, একটা কিছু ব্যবস্থা করুন। নইলে মামাকে ওরা…’ আর কিছু বলতে পারলাম না। ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললাম। কথা শুনে ক্লাবকর্তারা তো থ। হোমরাচোমরা গোছের একজন আমার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে মাইকে ব্যাপারটা ঘোষণা করলেন। কিন্তু না, তাতেও কোনো কাজ হলো না। শেষমেশ ক্লাব সদস্যদের সক্রিয় সহযোগিতায় ছোট মামাকে পাবলিকের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনা গেলেও মাঠে রাখা গেল না। ভ্যানগাড়িতে করে মাঠ থেকে সোজা নার্সিং হোমে। বাদল মামা, শ্যামল মামাদের অবস্থা অতটা খারাপ না হলেও নেহাত মন্দ নয়। মামাকে বাঁচাতে পাবলিকের কিল, ঘুষি, লাঠি ওদেরও হজম করতে হয়েছে।
তবে কিনা সান্ত্বনা একটাই—এত লোককে বোকা বানানোর জন্য প্রথম পুরস্কার দিয়ে বিচারকেরা মামাকে সম্মান জানিয়েছেন। যদিও পুরস্কার নেওয়ার জন্য মামা সশরীরে স্টেজে হাজির হতে পারেননি।
প্রশান্ত সরদার: ভারতীয় লেখক।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ০২, ২০১০
Leave a Reply