আপনারাই বলুন, কিছু না জেনে এবং না বুঝে কী করে বেঁচে থাকা সম্ভব?
সে অনেক আগের কথা। আমি তখন যুবক এবং আমার হবু স্ত্রীর মন পাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব দিতে সাহসে কুলোচ্ছিল না। সেই সময় একদিন ছোট্ট এই ঘটনাটি ঘটেছিল।
পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম আমরা। হঠাৎ শুরু হলো বজ্রপাত। লক্ষ করলাম, মাশা ভয় পাচ্ছে। তার চোখে জল। যতবার বজ্রপাতের শব্দ হচ্ছে, ততবার আর্তচিৎকার দিয়ে উঠছে সে এবং প্রতিবারই প্রায় জ্ঞান হারানোর দশা তার।
কাছে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দিলাম ওকে। কী বলেছিলাম ওই সময়, এখন আর মনে পড়ে না। পরে যখন আকাশ পরিষ্কার হয়ে রোদ উঁকি দিল, জিজ্ঞেস করলাম, ‘বজ্রপাতের শব্দকে এত ভয় পাও কেন?’
‘বজ্রের গর্জনে মানুষ মারা যেতে পারে।’ বলল সে।
‘তুমি স্কুলে পড়াশোনা করেছ তো?’ প্রশ্ন করলাম।
‘করেছি।’
‘ফিজিকসে কত পেয়েছিলে?’
‘চার’ (পাঁচে চার।—অনুবাদক)।
‘তবে তো তোমার জানার কথা যে বিদ্যুৎটাই শুধু বিপজ্জনক। বিদ্যুৎ চমকে গেলে বজ্রের গর্জনটা হলো ফাঁপা আওয়াজ—বায়ুমণ্ডলের কম্পন।’
মাশার চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝে গেলাম, আমার কথাগুলো কাজ করেছে বজ্রের গর্জনের মতো, অর্থাৎ ফাঁপা আওয়াজের মতো। তক্ষুনি একটা আইডিয়া খেলে গেল মাথায়, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আকাশ নীল কেন, বলো দেখি?’
‘জানি না। হয়তো বায়ুমণ্ডল নীল বলে।’
তার উত্তর আমাকে তৃপ্ত করল না। তাই প্রশ্ন করলাম, ‘আর বায়ুমণ্ডল নীল কেন?’
‘যে কারণে গাছের পাতা সবুজ। রংটাই অমন।’
‘আচ্ছা, বলো তো, কাঠ পোড়ার সময় মটমট শব্দ হয় কেন?’
‘ফেটে ফেটে যায় বলে।’
‘কেন ফাটে?’
‘গরমে।’
‘তবে আমরা কেন গরমে ফেটে যাই না?’ ভারি রাগ হলো আমার!
‘কেন, গরমে তো এমন অবস্থাও হয় আমাদের, যখন মনে হয়, এই বুঝি মাথা ফেটে যাবে।’
‘তোমার বিদ্যের দৌড় যা দেখছি, তাতে টিভির ভলিউম কমানোর প্রয়োজন হলে তুমি প্লাগপয়েন্ট থেকে প্লাগ খানিকটা টেনে বের করবে’, বললাম তাকে।
কেঁদে ফেলল সে।
আমি ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলাম তক্ষুনি।
বিয়ের পরে বহুবার তাকে অনেক কিছুর কার্যকারণ বোঝানোর চেষ্টা করে প্রতিবারই হতাশ হতে হয়েছে। দেখেছি, ওসবে উৎসাহ তার একেবারেই নেই। একটা কিছু বিশ্লেষণ করতে মুখ খুললেই সে বলে, ‘তুমি আমাকে ভালোবাস?’
‘বাসি।’
‘আর তুমি?’ জিজ্ঞেস করি অভ্যাসবশে।
‘না বাসলে তোমার আঁতলামি শুনতাম না বছরের পর বছর ধরে!’
বলে সে চলে যায় আলু ভাজতে, অথচ ভাজা আলুর ওপরে শক্ত আবরণ পড়ে কোত্থেকে, সে বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই তার।
নিশ্চিত জানি, জিজ্ঞেস করলেই বলবে, তেল থেকে।
আলুর মাড় বেশি তাপমাত্রায় শক্ত হয়ে যায়—এই সরল সত্যটিও যদি সে জানত!
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৯, ২০১০
Leave a Reply