এই তো, মাত্র কদিন আগে ইউরোপের আকাশ ছাই-মেঘে সয়লাব হয়ে গেল। আকাশে ওড়াউড়ি বন্ধ হয়ে বিমানগুলো তখন ঠায় মাটিতে বসা। বিমানের যাত্রী হিসেবে আমিও বার্মিংহামে বন্ধুর বাড়িতে গৃহবন্দী। ইংল্যান্ডে তখন নির্বাচনের নিঃশব্দ তোলপাড়। বন্ধুর বাড়িতে অলস বেলায় মন-প্রাণ ঢেলে নির্বাচনের লিফলেট পড়ি। এক সকালে একগাদা লিফলেট থেকে এক অদ্ভুত লিফলেট আবিষ্কার করলাম। সাদা-কালো অতিসাধারণ এক লিফলেটে প্রার্থীর হাসিমুখের ছবির পাশে উৎকীর্ণ বাণী—‘আমি আদি অকৃত্রিম কনজারভেটিভ। পার্লামেন্টে পাঠালে আমি ধন্বন্তরি আইন বানিয়ে দেশের অর্থনীতিতে তরতর বেগে প্রাণের বন্যা বইয়ে দেব। হে আমার প্রাণপ্রিয় ভোটারগণ, তোমরা লেবারদের বিশ্বাস কোরো না। ওরা এই দেশের অর্থনীতির বুকে শক্তিশেল মেরে দেশটাকে মাটির সঙ্গে বিছিয়ে দিয়েছে। তবে আমাদের আরডিংটন এলাকায় লোকাল কাউন্সিলর হিসেবে এই লেবার ব্যাটাকে ভোট দিয়ো। এই লেবার ব্যাটা নিজেও যোগ্য আর আরডিংটনের পার্কগুলোকে কুকুরের বর্জ্যমুক্ত রাখার কাজে ওর বুড়ি বউটা খুব নিরলস।’ হায় খোদা! এ কোন নির্বোধ নির্বাচন। নির্বাচন মানে মানুষে মানুষে সয়লাব, মিছিলের গা-ফুঁড়ে ছন্দোময় স্লোগানের ধ্বনি—‘অমুকের দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে।’ আহা। অমন মিছিল চোখে দেখেও সুখ—অমন স্লোগান কানে শুনেও সুখ। ওদের নির্বাচনে এক দলের এমপি প্রার্থী কর্তৃক আরেক দলের কাউন্সিলর প্রার্থীর ভোট চাওয়ার বেতালা নির্বুদ্ধিতা দেখে ছিঃছিক্কার ভরা মনে সে রাতে ঘুমোতে গেলাম।
ঘুমের ঘোরে এক জমজমাট আষাঢ়ে স্বপ্ন আমার দুই চোখের পাতায় ঘনিয়ে এল। স্বপ্নে দেখলাম, আমার নিজের দেশে নির্বাচন হচ্ছে। সেই নির্বাচনে রাস্তা খুঁড়ে বাঁশ পুঁতে তোরণ বানানো হয়নি। গমগমে আওয়াজ, ঠাসা গা ছমছম করা মিছিল নেই। চারদিকে সবকিছু ছিমছাম, স্বাভাবিক। এমন পরিপাটি শান্ত পরিবেশে গুলিস্তানের মোড়ে দাঁড়িয়ে এক নেত্রী বলছেন, ‘আপনারা আমাকে ভোট দিন। আমি আপনাদের অনেক বিদ্যুৎ বানিয়ে দেব।’ মনোহর হাসি দিয়ে উজ্জ্বল মুখে আরেক নেত্রী বলছেন, ‘উনার পাশাপাশি আমাকেও ভোট দেবেন। আমি দেশজুড়ে সার সার বিদ্যুতের পিলার পুঁতে দেব। আমার আপার বানানো বিদ্যুৎ চোখের নিমেষে আপনাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমাকে দিতেই হবে।’
তাঁদের দুজনের মুখের অনাবিল হাসি আমার স্বপ্নের রাজ্যে হানা দিতেই হাসতে হাসতে আমার সুখের ঘুম ভেঙে গেল। ভাবলাম, ঈশ্বর আমাকে আষাঢ়ে গল্প লেখার পাপ থেকে মুক্তি দিয়ে আষাঢ়ে স্বপ্ন দিয়ে আমার ঘুমের রাজ্য সয়লাব করে দিয়েছেন। মনে মনে ডয়েস বন্ধুদের দোয়া ও স্মরণ করলাম, ‘জি শ্লাফেন গুট উন্ট জি ট্রাউমেন জুস।’ অর্থাৎ সুখস্বপ্নে মজে থেকে আরামে ঘুমাও। দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তেই কড়াইল বস্তিতে ফের নেতাদের দেখা পেলাম। নেত্রীরা ওখানে নির্বাচনী গণসংযোগে ব্যস্ত। একজন বলছেন, ‘আপা, এই ভোটারগুলো আকাট মূর্খ। এদের ভালো কিছু বোঝাতে আমাদের একটু কৌশলী হতে হবে। সামান্য হাসপাতাল চেনাতে ওদের সূর্যের হাসির নিচে আবার সবুজ ছাতা মেলে ধরতে হয়। দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রের তথ্য-উপাত্ত পানি দিয়ে নরম করে গিলিয়ে দিলেও এরা গলায় আটকে পট করে মরে যাবে। তার চেয়ে বরং মূর্খগুলোকে গল্পের ছলে দারিদ্র্য বিমোচনের বিষয়টা হালকাভাবে বুঝিয়ে বলি।’ একজন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতে আরেকজন গল্প শুরু করলেন।
এক দেশে এক ছিল বুড়ো সিংহ। বয়সের ভারে বেচারার দাঁতগুলো একেবারে নড়বড়ে। কোনোমতে গতর নাড়িয়ে কচি-ক্যাচড়া একটা হরিণের ছানা ধরে আঁচড়ে-কামড়ে খেতে পেলে অর্ধেকটা তার পেটে যায়, বাকি অর্ধেক নড়বড়ে দাঁতের ফাঁকে বেমক্কা লটকে থাকে। রাত নামলে সিংহের দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে আসতেই বনের তাবৎ ইঁদুর বেচারার দাঁতের ফাঁকে লটকে থাকা মাংসের ওপর হামলে পড়ে। ইঁদুরের অত্যাচারে বেচারা বুড়ো সিংহ সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। বুড়ো বয়সে এমন নির্ঘুম রাত কাঁহাতক জানে কুলায়। অনেক ভেবে সিংহ খুঁজে পেতে এক বিড়ালকে ডেকে ইঁদুর তাড়ানোর চাকরি দিয়ে এবার খানিক নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যায়। বিড়াল কর্তব্যপরায়ণ। নির্ঘুম জেগে থেকে মিউ মিউ করে রাতভর সে ইঁদুর তাড়ায়। চাকরির আনন্দে বিড়াল সুখী, ঘুমানোর আনন্দে সিংহও সুখী।
এর মধ্যে একদিন শালির বিয়ের দাওয়াত পেয়ে বিড়াল সাত দিনের ছুটি নিয়ে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গেল। যাওয়ার আগে নিজের উঠতি জওয়ান ছেলেটাকে রাত জেগে ইঁদুর তাড়ানোর কাজ বেশ করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল। ছুটি শেষে বিড়াল তার কাজে যোগ দিতে গিয়ে ভারি একটু ধন্ধে পড়ে যায়। তার বিগ বস অন্নদাতা সিংহের কথায় বিনয়ের নির্ঝর, তবে ঠোঁটের কোণে বিটকেলে পিছলা হাসি। বিড়ালকে ডেকে পাশে বসিয়ে মাখো মাখো স্বরে সিংহ বলে, ‘বাবা বিড়াল, ইঁদুর তাড়ানোর কাজে তোমার তরুণ ছেলেটির অনন্য অবদান আমি সারা জীবন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করব। আর ইয়ে হে হে। কাল থেকে তোমাকে আর কাজে আসতে হবে না।’
আচমকা বেকারত্বের ঘায়ে বিড়াল বেসামাল। ক্লান্ত পায়ে ঘরে ফিরে ছেলের কাছে তার সাত দিনের ইঁদুর তাড়ানোর বৃত্তান্ত জানতে চায়। দায়িত্ব পালনের গর্বে গর্বিত ছেলের ঝটপট জবাব, ‘বনের তাবৎ ইঁদুর দুই দিনে মেরে সাফ করে আমি সিংহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়েছি।’ হতাশাক্লান্ত বেকার বিড়াল বিলাপ করে কপাল চাপড়ে বলে, ‘ওরে চপলমতী মূর্খ বালক, ইঁদুরের ঘরে-সংসারে কিংবা বনে-বাদাড়ে জ্বালাতনই আমাদের রুটি-রুজির উৎস। ইঁদুর না বাঁচলে বিড়ালের চাকরি বাঁচে না।’ এ পর্যন্ত গল্প বলে এক নেত্রী হাঁপিয়ে উঠলে আরেক নেত্রী আগ বাড়িয়ে গল্প ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। কপালের ঘাম মুছে রুমাল দিয়ে বাতাস কেটে হেসে হেসে বলেন, ‘বুড়ো সিংহটা আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি। ওর দাঁতের ফাঁকে লটকে থাকা মাংসগুলো আপনারা মানে হতদরিদ্র জনগণ। আর ইঁদুরগুলো হচ্ছে দারিদ্র্য—দিনরাত আপনাদের কুরে কুরে খায়। হে হে, আমরা কারা সেটাও কি আপনাদের বুঝিয়ে বলতে হবে? নিশ্চয়ই না।’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৯, ২০১০
Leave a Reply