আর্জেন্টিনা বিদায় নেওয়ার পর থেকে বাবা কাচের গ্লাসে চা খাওয়া শুরু করেছেন। চায়ের কাপ দেখলেই তাঁর নাকি বিশ্বকাপের কথা মনে পড়ে। তা তো পড়বেই। চারটা গোল খাওয়া সহজ কোনো ব্যাপার নয়। বাবা চেষ্টা করছেন বিশ্বকাপের দুঃসহ স্মৃতি ভুলে যেতে। কিন্তু পারছেন না, কোনো না কোনোভাবে চার গোলের কথা চলেই আসছে। সেদিনকার ঘটনা, কলবেল শুনে বাবা দরজা খুলতেই এক ভিক্ষুক বলল, ‘ট্যাকা দ্যান গো স্যার, চাইরটা ভাত খামু।’ বাবা সঙ্গে সঙ্গে খেপে গেলেন। ‘এই মিয়া, এত কিছু থাকতে তুমি চারটা ভাত চাইলে কেন? আমার সঙ্গে মশকরা করো? সুস্থ মানুষ, কাজ করে খেতে পার না? কত বড় সাহস! বলে চারটা ভাত খামু।’ আমি বাবাকে ভেতরে পাঠিয়ে দিলাম। চার সংখ্যাটার সঙ্গে যে কত কিছু জড়িত তা ওই ভিক্ষুক বুঝবে কীভাবে? বেচারা কিছু না বুঝে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। আমাকে বলল, ‘ট্যাকা না দিলে না দিবেন, চাইরটা ভাত চাইসি, ঝাড়ি তো চাই নাই। ঝাড়ি দেন ক্যান?’ পকেটে দুই টাকার একটা ছেঁড়া নোট ছিল, ভিক্ষুককে সেটা দিতেই সে বলল, ‘ছিঁড়া নোট নেই না, বদলাইয়া দ্যান।’ বিশ্রি অবস্থা! সন্ধ্যায় আবার পাশের বাসার আঙ্কেল বাবাকে দেখে বললেন, ‘একটা অদ্ভুত মিল ধরতে পারছেন ভাই? আপনি থাকেনও চার তলায়, গোলও খেলেন গুনে গুনে ঠিক চারটা। অদ্ভুত না?’ বাবা আঙ্কেলকে অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে কাবু করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বললেন, ‘পরেরবার ১২ তলায় বাসা নিয়ে ১২ গোল খাব, আমরা ভাত-তরকারির মতো গোলও বেশি খাই, আপনাদের মতো কিপটা না।’ চার গোল খাওয়ার পর থেকে বাবার মেজাজ খুব বেশি খারাপ হয়ে গেছে। সামান্য খেলা নিয়ে কেউ এমন করে? আরও উসকানি দিচ্ছেন মামা। তিনি ব্রাজিলের সাপোর্টার। ব্রাজিল হেরে যাওয়ার পর বাবা মামাকে অনেক কথা শুনিয়েছেন। পা নাচাতে নাচাতে আমাকে বলছিলেন, ‘তোর মামাকে দেখ, মুখটা কেমন কমলার মতো হয়ে গেছে, আরে দেখ না। কোথাকার কোন হল্যান্ড, তার কাছে হারে! যা, তোরা ওকে কমলা এনে দে। কমলায় আছে ভিটামিন সি!’ সেসব কথার মোক্ষম জবাব দেওয়া তো মামার দায়িত্ব। মামা মহা আনন্দে সেই দায়িত্ব পাালন করছেন। আমাকে বলছিলেন, ‘চার বছর ধরে এই চার গোলের খোঁটা দেব, বুঝলি?’
‘হুম।’
‘হুম কিরে বেয়াদব? জি বলতে পারিস না?’
‘জি, জি।’
‘দুবার বলার দরকার কী? আমি কানে কম শুনি নাকি? গাধার গাধা!’
বাসায় কেমন যেন একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। বাবা তার ইজি চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলেন, হঠাৎ মামা এসে চার আঙুল দেখিয়ে স্যালুট দিয়ে (আর্জেন্টিনা চার গোল খাওয়ার পর থেকে দেখা হলেই মামা চার আঙুল দেখিয়ে সালাম দিচ্ছেন) হাসিমুখে বললেন, ‘কী দুলাভাই, দুধ ছাড়া চা খাচ্ছেন কেন?’
‘দুধ ছাড়া চা খেলে তোমার কোনো সমস্যা আছে? তুমি কি দুধওয়ালা নাকি?’
‘রাগছেন কেন? বুঝতে পেরেছি। আপনারা তো দুধের স্বাদ “গোল”-এ মিটিয়ে ফেলেছেন।’
‘মানে? কী বলতে চাও পরিষ্কার করে বলো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।’
‘মানে সহজ। মানুষ দুধের স্বাদ ঘোলে মেটায়, আর আপনারা মিটিয়েছেন গোলে। ইস্! চার চারটা গোল! কী করে খেলেন দুলাভাই?’
‘আমরা গোল দিই বেশি, খাইও বেশি। তোমাদের কাকা তো কিছু করতে পারল না, ওর জায়গায় আমার বৃদ্ধ কাকা খেললেও দুটো গোল দিয়ে আসত।’
‘হেহ্, আপনাদের মেসিও তো গোল দিতে পারল না। চাঁন মিয়া হোটেলের মেসিয়ার খেললেও চার-পাঁচটা গোল দিত।’
‘খেলা তো বোঝো না। মেসির পাস থেকেই সব গোল হয়েছে। ওই দিনও ওর পাস থেকে গোল হয়েছিল। গোলটাকে অফসাইড না ধরলে আমরা কামব্যাক করতাম।’
‘আমাদের একটা গোলকেও তো অফসাইড দিয়েছে। ব্যাটা রেফরি কত বড় হারামি! আরে ব্যাটা, দুই পয়সার রেফরি, তুই অফসাইডের কী বুঝিস? হল্যান্ড যে অভিনয় করে ফাউল আদায় করল, তা দেখলি না?’
‘রাইট রাইট! তুমি তো বেশ বুদ্ধিমানের মতো কথা বলছ, আগে তো এত বুদ্ধিমান ছিলে না।’
‘আপনি তো আমার কথাই শুনতে চান না। আমার মতে, ফুটবল খেলাটাই ভুয়া। ক্রিকেট বা টেনিস দেখেন, কোনো ফাউল নেই, অভিনয় নেই। কী ভদ্র একটা খেলা।’
‘তা ছাড়া, বাংলাদেশ ক্রিকেট ভালো খেলে। আমরা শুধু শুধু ওই ব্রাজিল-ব্রাজিল করে লাফাই।’
‘আপনি কিন্তু আর্জেন্টিনার কথা বললেন না।’
‘ওই একই। যাহা ব্রাজিল, তাহাই আর্জেন্টিনা।’
‘এটা একটা খাঁটি কথা বলেছেন! দামি কথা।’
হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে মামা বললেন, ‘তুই এখানে বসে কী করছিস? যা, পড়তে যা।’
‘সেকি, ফাইনাল খেলা দেখব না?’
‘না, কিসের ফাইনাল? আমরা এখন ক্রিকেট দেখব। যা ভাগ। ফুটবল ভুয়া খেলা। বুঝেছিস?’
‘হুম!’
‘আবার বলে হুম? কত বড় বেয়াদব! দেখেছেন দুলাভাই?’
বাবা বললেন, ‘আমার হাতে গ্লাস না থাকলে ওকে কষে একটা চড় দিতাম। ফাইনাল দেখবে! গেলি এখান থেকে?’
‘জি।’
মামা বললেন, ‘একবার জি বলছিস কোন ভরসায়? এখানে আমরা দুজন মুরব্বি আছি। মুরব্বিদের সম্মান করতে হবে না?’
‘জি, জি।’ বলেই আমি চলে এলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, ফুটবল নাকি ভুয়া খেলা! কই, এত দিন তো ভুয়া বলেনি। পড়ার সময় বলেছে, ‘আরে, পরেও তো পড়তে পারবি, মেসি/কাকার খেলা দেখে যা। চোখ জুড়িয়ে যাবে।’ নিজেদের দল বাদ পড়ে গেছে তো, তাই আমাকে পড়তে পাঠিয়ে তারা এখন ক্রিকেট দেখবেন। অথচ আমার প্রিয় দল ঠিকই ফাইনালে উঠেছে। শুধু শুধু এই দুজনের জন্য আমি ফাইনালটা দেখতে পারলাম না। কেন যে মানুষ শুধু ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করে! দূর। ভালোই লাগে না।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১২, ২০১০
Leave a Reply