২০৫০ সালের ১২ জুলাই। ফতুল্লা স্টেডিয়ামটাকে ভেঙে নতুন করে বানানো হয়েছে। এক লাখ মানুষ একসঙ্গে বসতে পারবে এখানে। এটি ছিল একটা ছোট ক্রিকেট স্টেডিয়াম। কিন্তু সারা দিন ক্রিকেট খেলার সময় আর কার আছে, আর কে-ই বা দেখবে। তাই দেশ থেকে ক্রিকেট উঠেই গেছে বলা যায়। ফতুল্লা এখন বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক স্টেডিয়ামের একটি।
সব রাস্তা যেন আজ মিশেছে এই স্টেডিয়ামে। সকাল থেকেই আসতে শুরু করেছে সবাই। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসেছে। পোশাক আর টুপির রং দেখেই বোঝা যায় কে কোন দেশের। আর হাতে দোলানো জাতীয় পতাকা তো আছেই। সাজ সাজ রব চারদিকে। আজকের এই দিনটির জন্য চার বছর ধরে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। অবশেষে এসেছে সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি।
বাংলাদেশ যে সুযোগটি পাবে, তা জানাই ছিল। তাই যখন আয়োজক হতে চাইল, কেউ আপত্তি করেনি। তা ছাড়া এ ধরনের একটি অনুষ্ঠান করার সব ধরনের আর্থিক সক্ষমতা এখন বাংলাদেশের আছে। যে আয়োজন বাংলাদেশ করেছে তা অভিনব। এতটা জাঁকজমক আর কেউ কখনো করতে পারেনি। নতুন নতুন চমক তো আছেই।
প্রতিটা দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বেশির ভাগই এসেছেন বা তাঁদের প্রতিনিধিরা আছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব আছেন। আর আছেন বেঁচে থাকা বিখ্যাত সব সাবেক ফুটবলার।
২০৫০ সালের মানুষ ভয়াবহ ব্যস্ত। বসে থাকার কোনো উপায় নেই। প্রত্যেকের জন্যই কাজ ভাগ করা আছে। বয়স ও সামর্থ্য অনুযায়ী সবাইকে কাজ করতে হয়। ফলে বিকেলে মাঠে গিয়ে খেলাধুলার সময় আর সুযোগ কোনোটাই নেই। সারা বিশ্বেরই এখন এই অবস্থা। কিন্তু বিনোদনের প্রয়োজন রয়েছে। আর তাই চার বছর পরপর বিশ্বকাপ ফুটবল আসরের ঐতিহ্যটা রেখে দেওয়া হয়েছে। আজ শুরু হচ্ছে সেই বিশ্বকাপের নতুন আসর।
আসর বসবে বিকেল চারটায়। স্টেডিয়াম ভরে গেছে। দেশ অনুযায়ী গ্যালারি ভাগ করে দেওয়া আছে। ২৪টা দেশের ২৪ ধরনের রঙের গ্যালারিতে পরিণত হয়েছে ফতুল্লা স্টেডিয়ামটা। আর ভিআইপি গ্যালারিও পরিপূর্ণ। যাঁরা স্টেডিয়ামে আসতে পারেননি, তাঁদের জন্য রয়েছে সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা। বিশ্বের প্রতিটি দেশ আজকের বিশ্বকাপ সরাসরি দেখাচ্ছে। প্রতিটি দেশে মূল সড়কগুলোয় বড় পর্দার টিভি বসানো হয়েছে। আজ বিশ্বের সবাইকে—বলা যায়, ছুটি দেওয়া হয়েছে কাজ থেকে। দুই ঘণ্টা কাউকেই আজ কাজ করতে হবে না। কাজের মধ্যেও বিনোদনের প্রয়োজন আছে বলে এখন সবাই মানে।
বরাবরের মতো ৩২টা দেশ এবারের বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে, আটটা গ্রুপে ভাগ হয়ে। আট গ্রুপ থেকে ১৬টা দেশ যাবে দ্বিতীয় পর্যায়ে, নক আউট রাউন্ডে। বিজয়ী আট দল খেলবে কোয়ার্টার ফাইনাল। তারপর সব আগের নিয়মেই—সেমিফাইনাল, ফাইনাল ও তৃতীয় স্থান নির্ধারণী খেলা। বাংলাদেশ আছে বি গ্রুপে। বাকি দেশগুলোর নামে তেমন কোনো চমক নেই। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ইতালি, জার্মানি ও ফ্রান্স যেমন আছে, তেমনি এশিয়ার শক্তি কোরিয়া ও জাপানও আছে। আছে আফ্রিকার ঘানা, ক্যামেরুন ও নাইজেরিয়াও। মাঠে সারিবদ্ধভাবে দেশগুলোর ফ্ল্যাগ রাখা আছে। আর আছে ৩২টি বক্স। বক্স দেখলেই বোঝা যায়, কোনটি কোন দেশের জন্য তৈরি। মনে হচ্ছে, ফ্ল্যাগ দিয়েই বানানো হয়েছে বক্সগুলো। এবারের বিশ্বকাপের মূল চমকই এই বক্সে লুকিয়ে আছে।
২০৫০ সালে প্রতিটি মুহূর্তই দামি। তাই দুই ঘণ্টার অনুষ্ঠানে বাহুল্য বর্জন করা হলেও চমকের ঘাটতি রাখা হয়নি। ঠিক চারটার সময়ই শুরু হয়ে গেল অনুষ্ঠান। শুরুতেই সামান্য বক্তব্য পর্ব। ফিফার প্রেসিডেন্ট সেপ ব্ল্যাটার স্বাগত বক্তব্য দিলেন। এবারের বিশ্বকাপ যে অতীতের সব বিশ্বকাপের সাফল্যকে ছাড়িয়ে যাবে, সেই আশাবাদের কথাও বললেন। সময়ের চাহিদাকে মেনে নিয়ে এ রকম বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য স্বাগতিক দেশ বাংলাদেশের প্রশংসাও করলেন। এরপর বক্তব্য দিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। খুবই সংক্ষিপ্ত বক্তব্য। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কম কথা বলার জন্য এখন বিখ্যাত। তিনি সেই খ্যাতি রাখলেন।
এরপর মঞ্চ কাঁপাতে এলেন কাকিরা। এবারের বিশ্বকাপের থিম সংগীত ‘বাকারা বাকারা’ কাকিরাই গাইছেন। ১০ মিনিট বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষ মুগ্ধ হয়ে দেখল কাকিরাকে। কেউ জানল না, এই কাকিরা শাকিরা নামের ৪০ বছর আগের এক গায়িকার ক্লোন।
তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। শুরু হচ্ছে আসল বিশ্বকাপ। ফতুল্লা স্টেডিয়াম এ জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। মঞ্চ থেকে সরে গেলেন কাকিরা। মাঠ এখন পুরো ফাঁকা। একটি মানুষও কথা বলছে না। কেবল মিউজিক বাজছে। তারপর এল সেই ঘোষণা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ফিফার প্রেসিডেন্ট যৌথভাবে বিশ্বকাপ শুরুর ঘোষণা দিলেন। পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে আধুনিক স্টেডিয়ামটার মাঝখানটার মাটি আস্তে আস্তে দুই পাশে সরে যেতে শুরু করল। মাটি ভেদ করে উঠে এল অ্যাকুরিয়ামটি। স্বচ্ছ কাচের কারণে ভেতরটা খুব ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ দেখল পল নামের অক্টোপাসটাকে। শুরু হয়ে গেল খেলা।
নিয়ম-কানুন আগের মতোই রাখা হয়েছে। গ্রুপ অনুযায়ী খেলা হয়েছে। ‘এ’ গ্রুপের আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়া দিয়ে খেলা শুরু। আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়ার নামে তৈরি করা বক্স দুটি রাখা হলো অ্যাকুরিয়ামের মধ্যে। তারপর ছেড়ে দেওয়া হলো পলকে। পল ধীরে ধীরে বসল আর্জেন্টিনার বক্সের ওপর। এভাবে প্রথম ১৬টি দলকে বেছে নেওয়া হলো। সেখান থেকে আটটি। সেমিফাইনাল হলো চারটি দেশের মধ্যে। আর সবশেষে যথারীতি ফাইনাল খেলা।
সব মিলিয়ে দুই ঘণ্টার বেশি লাগল না এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল শেষ হতে। এর মধ্যে পল নিল এক ঘণ্টার বেশি সময়। ২০৫০ সালের মানুষের কাছে সময়ের মূল্য অনেক বেশি। একদল মানুষ মাঠে গিয়ে খেলা দেখবে, আরেক দল খালি খেলবে—এত সময় কোথায়। তার চেয়ে পলই ভালো। আর সফল একটি বিশ্বকাপ আয়োজন করতে পেরে সারা বিশ্বে মর্যাদা বাড়াল বাংলাদেশ।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১২, ২০১০
Leave a Reply