‘তোমার দেখা সড়ক দুর্ঘটনার বিবরণ জানাইয়া তোমার বন্ধুর নিকট একখানা পত্র লেখো’—বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে এই ধরনের নির্দেশ পেয়ে আমরা বহু পত্র লিখেছি। কিন্তু ফুটবল খেলার বিবরণ জানিয়ে কখনো পত্র লিখেছি কি? না, লিখিনি। আমরা না লিখলেও কেউ কেউ লিখেছে। তাদেরই কয়েকজনের পত্রের কপি তুলে ধরেছেন ইকবাল খন্দকার
বন্ধুর কাছে বন্ধুর পত্র
প্রিয় আবুল খায়ের,
কেমন আছিস, দোস্ত? আমি কিন্তু হেভি মউজে আছি। কারণ, পাশের বাসায় গিয়ে খেলা দেখার অনুমতি মিলেছিল। পাশের বাসা বলতে কার বাসার কথা বোঝাচ্ছি, নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছিস। আরে, ওই যে ওই মেয়েটার। যে তোর পেছনে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল। এক মাস পাশাপাশি বসে খেলা দেখার কারণে তার সঙ্গে এখন আমার হেভি খাতির। ফাইনালে আমার অন্য দল প্রিয় হলেও তার প্রিয় দলকেই আমার প্রিয় দল বানিয়ে নিয়েছিলাম। ফাইনাল তো বটেই, অন্যান্য খেলায়ও তার নির্দেশে বিস্তর হাততালি দিতাম। তার হাতে বেশির ভাগ সময়ই মেহেদি থাকত তো! তাই তার তালিটাও আমাকে দিয়েই দেওয়াত। তালি দিতে কষ্ট হলেও খেলা দেখে খুব ভালো লেগেছে। তবে খেলার পূর্ণ বিবরণ দিতে পারছি না এই জন্য, আমি ফাঁকে ফাঁকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তুই তো জানিস, আমার ঘুমের অভ্যাসটা একটু বেশি। মনে নেই, একবার পরীক্ষার হলে খাতার ওপর মাথা রেখে কী ঘুমটাই না দিয়েছিলাম!
ইতি—
তোর বন্ধু হারিছ মিয়া
বখাটের কাছে বখাটের পত্র
হাই চিকু,
হাউ আর ইউ? (অনুবাদ) আছিস কেমন? বেশ কদিন তোর সঙ্গে গার্লস স্কুলের সামনে দেখা হয়নি। বুঝতে পেরেছি, আমার মতো তুইও বিশ্বকাপ নিয়ে ব্যস্ত ছিলি। যা-ই হোক, ফাইনাল খেলাটাও তো শেষ হয়ে গেল। সেই খেলা সম্পর্কে কিছু বলার জন্যই তোর কাছে চিঠি লেখা। আসলে চিকু, খেলার শুরুর দিকে আমার চোখ বল আর প্লেয়ারের দিকেই ছিল। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ চলে গেল গ্যালারিতে। সঙ্গে সঙ্গে কী যে হলো, কী আর বলব রে মামা। এককথায় আজব। আমরা তো হুদাই গার্লস স্কুলের সামনে গিয়া দাঁড়ায়া থাকি। যাদের জন্য দাঁড়ায়া থাকি, তাদের তুলনায় গ্যালারির মাইয়াগুলা ঐশ্বরিয়া। মামা, এই বছর যা হওয়ার হইছে। আগামীবার কীভাবে বিশ্বকাপ খেলা দেখতে ওই দেশে যাওয়া যায়, সেই ব্যবস্থা কর। কারণ, যত দিন পর্যন্ত গ্যালারির ওই ডানাকাটা পরিদের সঙ্গে বসে খেলা দেখতে না পারব, তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে না পারব, তত দিন আমার শান্তি নাই। আমি কী দেখলাম রে মামা কী দেখলাম! তোর কাছে খেলার বিবরণ কী দিমু। আমি নিজেই বলতে পারমু না কে কয় গোল করছে। তুই আমারে একটু জানাইস। সরি, তুই তো আবার লেখাপড়া জানিস না। তবু কাউকে দিয়ে চিঠিটা পড়াস।
ইতি—
মোটরসাইকেলওয়ালা মাইকেল
ঝালমুড়িওয়ালার কাছে ঝালমুড়িওয়ালার পত্র
প্রিয় সেকান্দর ভাই,
ঘন ঘন বিয়া করার খাসলতটা কইমা থাকলে আশা করি ভালোই আছেন। বিশ্বকাপ তো মিয়া গুরুতর মজা কইরা দেখলাম। জানেন তো, আমার এলাকায় টিভির কোনো অভাব নাই। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মুড়ি বেচতে বেচতেই দেখা হইয়া যাইত। কারণ মাঠে-দোকানে সব জায়গায়ই টিভি। খেলাগুলা গুরুতর মজা কইরা দেখেছি ঠিক, তবে প্রায় সময়ই কান্দুন আইত। ক্যান আইব না কন, যেই ইস্টেডিয়ামে খেলাটা হইল, সেইখানে হাজার হাজার মানুষ। অথচ একটা ঝালমুড়িওয়ালাও নাই। একবার চিন্তা কইরা দেখছেন, এইটা কত বড় অমানবিক ঘটনা। এতগুলি মানুষ খেলা দেখল অথচ মুড়ি খাইতে পারল না। ওই দেশে ঝালমুড়িওয়ালা নাই, এটা আমাগোরে আগে জানাইব না? একটা ফোন কইরা দিলেই তো চইলা যাইতাম। আমার মোবাইলে তো বিদেশি ফোন আসে। তাইলে একটা ফোন করলে কী এমন গুনাহ্ হইয়া যাইত? আসলে খেলা কেমুন হইছে, এইটা এখন কইতে চাইতাছি না। একদিন আমার এলাকায় আসেন, চা-পান খাইতে খাইতে বিবরণ দিমুনে। তবে চিন্তা নাই, চা-পানের বিল আমিই দিমু।
ইতি—
সবদর আলী
ছোট ভাইয়ের কাছে বড় ভাইয়ের পত্র
স্নেহের লোকমান,
ছোটবেলা থেকেই তোর অভ্যাস, আমি পড়ার কথা বললেই মাথাব্যথা আর পেটব্যথার ভান করা। এখন যেহেতু আমি তোর কাছে নেই, অতএব তোর মাথাব্যথা-পেটব্যথা থাকবে না, তুই ভালো থাকবি—এটাই স্বাভাবিক। গ্রামে তো বিদ্যুতের ‘এই আছে এই নাই’ অবস্থা। নিশ্চয়ই তুই ভালোভাবে বিশ্বকাপ দেখতে পারিসনি। নো প্রবলেম, আমি তোকে আমার দেখা খেলার বিবরণ দিচ্ছি। তুই তো জানিস, আমি স্কুলে ক্যানভাসারের অভিনয় করে পুরস্কার পেয়েছিলাম। তার মানে, আমি ভালোই চাপা পেটাতে পারি। শোন, খেলা এতটাই জমজমাট হয়েছে যে একেকটা গোলের পর আমরা ‘গোল’ বলে বিকট চিৎকার দিয়েছি। আমার এক বন্ধু তো চিৎকার দিতে গিয়ে গলার রগ ছিঁড়ে ফেলেছে। আরেক বন্ধু গোল বলে লাফাতে গিয়ে টেবিলের পায়ায় বাড়ি লেগে পায়ে ব্যথা পেয়েছে। কিন্তু যে-ই না ডাক্তার তার পায়ে ব্যান্ডেজ করতে গেল, হঠাৎ আবার সে গোল বলে চিৎকার করে এমন জোরে পা ছুড়ে মারল যে, ডাক্তার ছিটকে গিয়ে একটু দূরেই পড়ল। এ নিয়ে এখানে একটু গরম পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আজ রাখছি।
ইতি—
তোর ফুটবল বিশেষজ্ঞ বড় ভাই
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১২, ২০১০
Leave a Reply