এত দিন জানতাম, ফুটবলের নম্বর থাকে। বলের সাইজ অনুযায়ী নম্বর হয় ২ নম্বর, ৩ নম্বর, ৪ নম্বর, ৫ নম্বর! এবারই প্রথম জানলাম, এখন ফুটবলেরও নাম থাকে। যেমন, এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের একটা আলাদা নাম রাখা হয়েছে—জাবুলানি। জাবুলানি মানে কী?
বিশ্বকাপ ফুটবল যাঁরা খেলছেন, তাঁদের জাবুলানির অর্থ নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু সব দলের গোলরক্ষকেরই সব দুশ্চিন্তা এই জাবুলানি নিয়ে। কারণ, অনেকেই অভিযোগ করেছেন, জাবুলানি তৈরিতে কোনো একটি কারিগরি ত্রুটি আছে। গোলরক্ষকেরা সহজে এটাকে গ্রিপে ধরে রাখতে পারছেন না! ছুটে যায়।
আমার কথা হলো, না পারলে নেই। এতে যদি দর্শক বেশিসংখ্যক গোল দেখতে পারে, সেটাই বরং ভালো।
২.
আমি বিশ্বকাপ ফুটবল দেখি ১৯৮২ সাল থেকে। সেই হিসাবে এটা আমার অষ্টম বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আমাদের উৎসাহ আর আয়োজন ছিল ব্যাপক। খেলা দেখতাম দলবেঁধে। আমাদের সেই দলের সবচেয়ে উৎসাহী দর্শক ছিলেন আমার মামাতো ভাই, যিনি পেশায় স্কুলের সহকারী শিক্ষক। ব্রাজিলের একনিষ্ঠ সমর্থক। সেবার ব্রাজিলের সঙ্গে স্কটল্যান্ডের প্রথম খেলা। ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের দেখেই তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। বললেন, ‘সব বাচ্চা প্লেয়ার। একজনেরও মুখে দাড়িগোঁফ উঠে নাই। এরা পারবে?’
ব্রাজিলের তখনকার গোলকিপারের নাম ছিল তাফারেল। সেটি ছিল তাঁর তৃতীয় বিশ্বকাপ। সিনিয়র প্লেয়ার। মাথার চুলটুল পড়ে একটা ছোলা ভাব চলে এসেছে। তাফারেলকে দেখিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করার জন্য বললাম, ‘এই যে একজন সিনিয়র প্লেয়ার।’
তিনি আরও হতাশ হলেন। বললেন, ‘ইনি তো কুইচ্যা মুরগির মতো ঝোগা হয়ে গেছে। আমার ভয়ই লাগে, কখন পট করে গোল খেয়ে যায়। বুড়া মানুষে ভরসা কম!’
ভাগ্য ভালো, তখন জাবুলানি ছিল না। বুড়া গোলকিপারের জন্য এই বল ধরা তাহলে আরও কঠিন হতো। ব্রাজিলিয়ানদের চেয়ে স্কটিশরা অনেক হেভি। বয়সী। সেটা মাস্টার সাহেবের দুশ্চিন্তাকে আরও বাড়াল।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, খেলা শুরুর চতুর্থ মিনিটেই ব্রাজিল গোল করে ফেলল। মামাতো ভাই উত্তেজনায় সোফায় লাফ দিলেন। সোফার পায়া ভেঙে গেল। তিনি পা মচকে ফেললেন। ব্যথা ভুলে গিয়ে বললেন, ‘সব ধাননা (ধানি) মরিচ। বারুদ ভরা। জিল-জিল-ব্রাজিল!’
বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলাগুলোতে তাঁকে খুব মিস করি।
এবার ব্রাজিল-আইভরিকোস্ট খেলার আগে ফোন করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘খেলা দেখবেন না?’
উত্তরে জানালেন, তিনি দল বদল করেছেন। ব্রাজিল এখন আর তাঁর ফেবারিট না। বর্তমানে তাঁর প্রিয় দল হচ্ছে আর্জেন্টিনা। আমি অবাক হলাম। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের মতো বিশ্বকাপ ফুটবলেও যে দলবদল ঘটতে পারে, আমার ধারণায় ছিল না।
৩.
বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আগে অনেক মাতামাতি হতো। খেলা নিয়ে আলোচনা হতো। ঘরের মধ্যে পিতামাতা-ভাইবোন-আত্মীয়দের মধ্যে দলাদলি হতো। বাজি হতো। খাওয়াখাওয়ি হতো। পাড়া-মহল্লায় খেলাকে কেন্দ্র করে জটলা হতো। আড্ডা হতো। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল, রাতে চুরি-ছিনতাই প্রায় বন্ধ হয়ে যেত। সবাই মেতে থাকত বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার উৎসবে। সেসব খবর পত্রিকায় আসত।
এবার পত্রপত্রিকায় প্রচুর পতাকার ছবি ছাপা হয়েছে। প্রিয় দলের পতাকা কে কত বড় করে বানিয়েছে, সেই সংবাদ ছাপা হয়েছে। পত্রিকার ছবি বা খবর দেখে তার চেয়ে বড় পতাকা বানানোর প্রতিযোগিতাও হয়েছে। সেই খবরও সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে।
আবার কিছু পেছনের খবর আসেনি। আমার এক ছোট ভাই পুরান ঢাকার ভজহরি সাহা স্ট্রিটে থাকে। নাম আকাশ। চিনিকলের পার্টসের ব্যবসা করে। পতাকাওয়ালারা তার কাছে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছে। সে নিরুপায় হয়ে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা দিতে
সম্মত হয়েছে। তার কথা হলো, ‘খেলা হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকায়, সে জন্য বাংলাদেশে বসে আমি পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দেব কেন? টাকা তো গাছের পাতা না যে, ঝাঁকি দিলে পড়বে।’
তারা ৫০০ টাকা নেয়নি। হুমকি দিয়েছে। চাঁদাবাজদের ভয়ে গত শুক্রবার রাতে সে এলাকায় আর ফিরে যায়নি।
কাফরুলে আরেক লোক ৫০ টাকা চাঁদা দিয়ে বেইজ্জতি হয়েছেন। এলাকায় অনেকেই তাঁকে ‘কঞ্জুস মাখখি চুষ’ বলে আড়ালে নিন্দা করে। কৃপণতার কারণে তাঁর কাছে ‘চান্দা পাট্টি’র সর্বনিম্ন রেট ছিল ৫০০ টাকা। ৫০ টাকা দেওয়া মানে তাদের অপমান করা। সে জন্য তারাই চাঁদাদাতাকে গালিগালাজ করে মানহানি করেছে।
এ রকম আরও কিছু ঘটনা শুনেছি। জেনেছি। এই চাঁদাবাজির ব্যাখ্যা কী হতে পারে?
ফুটবল জাবুলানি নিয়ে যেমন বিশ্বকাপের গোলকিপাররা বিপদে আছেন, তেমনি বড় দলগুলো ফাইনালে উঠলে চাঁদাবাজদের এই বিপদ আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে। দেখা যাক কী হয়!
অনেক পাঠকই হয়তো কৌতূহলী হবেন, এত কিছু
থাকতে ফুটবলের নাম জাবুলানি রাখা হলো কেন?
‘জাবুলানি, সাউথ আফ্রিকান শব্দ, যার অর্থ উদ্যাপন।
অনেক এলোমেলো কথা বলে ফেলেছি। আসুন,
আমরা সবাই বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১০ উদ্যাপন করি! আনন্দ করি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৫, ২০১০
Leave a Reply