আমার আদ্যিকালের বন্ধু কমোরা অভিনয় বিভাগের শিক্ষক। নিজের পেশার প্রতি তার অবিচল ও সনিষ্ঠ মনোযোগ। যখন সে কাজে মগ্ন, পৃথিবীর সবকিছু সে ভুলে যায় এবং প্রয়োজনবোধে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে মধ্যরাত অবধি।
দিন কয়েক আগে ঢুঁ দিলাম ওর ওখানে রাত নয়টার দিকে। ভেবেছিলাম বিয়ারপানের দাওয়াত দেব। গিয়ে দেখি, বরাবরের মতোই এক রিহার্সেল স্টেজের পাশে ঘর্মাক্ত অবস্থায় প্রাণপণে দুই হাত দিয়ে নানাবিধ ইশারা করে ১২-১৪ জন যুবক প্রতিভাকে ট্র্যাজিক দৃশ্যে অভিনয়ের শিক্ষা দিচ্ছে।
এই ছেলেগুলোকে দেখো—ফিসফিস করে ও বলল আমাকে, এমন অপদার্থ গ্রুপের সঙ্গে আগে আর কখনো আমাকে কাজ করতে হয়নি।
দেখলাম, সত্যিই তাই। সুঠামদেহী যুবকেরা, যাদের প্রত্যেকে চাইলেই রাজমিস্ত্রির কাজ করতে পারে। অমানুষিক ব্যথা-বেদনা আর কষ্টের অভিব্যক্তি চেহারায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। থেকে থেকেই আনাড়ির মতো পড়ে যাচ্ছে স্টেজের ওপরে। ঠিক যেন বজ্রাহত, কোঁকাচ্ছে আড়ষ্টের মতো। স্বাভাবিকতার লেশমাত্র নেই তাতে। মৃগী রোগীর মতো খিঁচুনি দিয়ে কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায় এবং মারা যাচ্ছে সুনিপুণ অদক্ষতার সঙ্গে। অমন দেখতেও লজ্জা লাগে।
না, না, না—চিৎকার করে বলল কমোরা। চলবে না! বেজায় কাঁচা কাজ। দর্শকেরা বুঝে ফেলবে। তারা সব ঠিকঠাক বুঝতে পারে। তারা সব সময় সন্দেহপ্রবণ। তাদের প্রমাণ করে দেখাতে হবে, এটা অভিনয় নয়। খিঁচুনি দিতে হবে আরও আবেগসহকারে। মন দিয়ে কাতরাও, যন্ত্রণায় চিৎকার করো। কেমন ট্র্যাজিক পরিবেশে তোমাদের এই অভিনয় দেখাতে হবে, তা কি তোমরা কল্পনা করতে পারছ? তোমাদের ভয়ংকর প্রতিপক্ষ আঘাত করল নির্দয়ভাবে, আর তোমরা শুয়ে পড়ে কাতরাচ্ছ অসহনীয় যন্ত্রণায়। তোমরা এখনো সবাই যুবক, তোমাদের মৃত্যুর সময় এখনো ঘনিয়ে আসেনি বটে, কিন্তু অভিনয়ে দেখাতে হবে, মৃত্যুর দেরি নেই আর।
যুবকেরা ঘর্মাক্ত অবস্থায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা হয়তো ভাবতেও পারেনি, খ্যাতিমান হওয়ার পথটি এত বন্ধুর। কমোরার ইঙ্গিতে আবার শুরু হলো রিহার্সেল।
যথেষ্ট হয়েছে—একসময়ে বলে উঠল সে। বাড়িতে গিয়ে আয়নার সামনে অনুশীলন করবে সবাই।
তোমার ধারণা, এদের দিয়ে কিছু হবে?—রিহার্সেলের পর বাইরে বসে আমি জিজ্ঞেস করলাম কমোরাকে।
স্টেজে অবশ্যই কিছু হবে না ওদের দিয়ে—সম্মতির সুরে কমোরা বলল। হবে ফুটবল মাঠে। ‘ভিক্টোরিয়া’ ক্লাবের ফুটবলারদের জন্য এটা বিশেষ কোর্স।
এর্নস্ট রিল: জার্মানির লেখক
ভাষান্তর: মাসুদ মাহমুদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৫, ২০১০
Leave a Reply