আমি কেন ফুটবলের সমর্থক? এ কেমন গাধাটে প্রশ্ন! আমি সমর্থক এবং এর পেছনে রয়েছে চারটি মূল ও বেশ কয়েকটি গৌণ কারণ।
প্রথমত, কোত্থাও চিৎকার করার সুযোগ আমার নেই, কিন্তু চিৎকার করা আমার যে খুব দরকার! বুঝলেন, থেকে থেকেই চিৎকারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় আমার ভেতরে। না, কেউ আমার ওপরে চিৎকার করুক, সেটা নয়; দরকার আমার চিৎকার করা। এই কাজের জন্য ফুটবল মাঠের চেয়ে পোক্ত জায়গা আর নেই।
আমার অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করুন: এক অফিসের কর্মচারী আমি, বিয়ে করেছি বিশাল বপু, জগদ্দল (শরীর ও চরিত্র দুই-ই বুঝিয়েছি) এক রমণীকে। সুন্দরী বলা যাবে না তাঁকে। এই কারণে অথবা হয়তো অন্য কোনো কারণে আমাদের ছয়-ছয়টা ছেলেমেয়ে। সারাটা দিন আমি কাজ করি সুনসান পরিবেশে। সেখানে বসকে তো ‘কুঁড়ের হদ্দ’ বলতে পারি না! বলতে পারি না যে, যেকোনো কাজ তার চেয়ে ঢের ভালো করতে পারি! আর এটা তো স্রেফ ভয়াবহ অবিচার: অফিসে আমি সাদামাটা চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করি, আর সে আরাম করে কেবিনে বসে! আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান বলে নয়, স্রেফ ভাগ্যের ফেরে। এবং বুঝতেই পারছেন, সে আমার ওপরে চিৎকার করতে পারে, আমি তার ওপরে পারি না।
চিৎকার করতে পারি না বাসাতেও। স্ত্রী নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আপনারা তাকে দেখলে বুঝতেন, কেন তার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। এবং আমি সমর্থক হলাম কেন, সে প্রশ্নও করতেন না।
প্রতি রোববার আমি স্টেডিয়ামে যাই। ওখানে গেলেই কেবল নিজেকে মানুষ বলে মনে হয়। গেট থেকেই আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে শুরু করে দিই এবং ক্ষান্ত দিই ম্যাচ শেষ হওয়ার পর। রেফারিকে ‘গর্দভ’ ডাকার ভেতরে কী যে তৃপ্তি! আমার জন্য সেই মুহূর্তে রেফারি যে স্ত্রী, বস ও ছয় সন্তান! এমনকি যাত্রী-গিজগিজ ট্রামও।
আবার দেখুন, ফুটবল ছাড়া আর কোন বিষয় নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলা যায়? আমরা সবাই ফুটবল দেখতে যাই বলেই কথা বলার বিষয় একটি আছে আমাদের। বহু বছর আগে আমাদের জীবনে ফুটবল ছিল না। তারপর টনকে-টন কালি খরচ করে পত্রিকাগুলোয় ছাপা হতে শুরু করল ফুটবলারদের চুলের রঙের বিবরণ, তাঁদের অভ্যাস, মামা-চাচা-খালা-ফুফুর কথা, তাঁদের গাড়ির বর্ণনা। পত্রিকাগুলোই তো আমাদের সংক্রমিত করল! এখন আর কোনো বিষয়েই আমরা কথা বলতে পারি না। এ কারণেই আমি সমর্থক হয়েছি।
রোববার বিকেলে আর কোথায় যাওয়ার আছে, বলুন, যেখানে স্বল্পমূল্যে এমন মানসম্মত প্রদর্শনী দেখা সম্ভব? সিনেমা হলে লাইন, ক্যাফেতে একঘেয়ে, বিরক্তিকর। ষাঁড়ের লড়াই? বেজায় খরচের ধাক্কা। থিয়েটারগুলোতে রাবিশ। জানেন, হেমন্তকালে ঠাণ্ডা পড়ে এলেও স্টেডিয়ামে গেলে আমি কখনো জমে যাই না শীতে। তাই তো আমি ফুটবলের সমর্থক।
যৎকিঞ্চিৎ চাঁদা দিয়ে সমর্থক গোষ্ঠীর সদস্য হয়েছি। এখানে আমার কথার মূল্য দেয়। আর তাই বলি, ফুটবল দেখতে যাই এবং গিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করি বলে আমাদের সমালোচনা করবেন না। আমাদের নিয়তিই অমন…।
পাউপিকো: স্পেনের লেখক।
ভাষান্তর: মাসুদ মাহমুদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২১, ২০১০
Leave a Reply