সকালবেলা কাঁচি দিয়ে দাড়ি ছাঁটতে বসেছি, আর অমনি আমার ল্যান্ডফোনটা ভ-র্-র্-র্ করে বেজে উঠল। বিরক্ত হয়ে ফোন তুলতেই শুনি ম্যারার খসখসে গলা। ম্যারা হচ্ছে, আপনারা যাকে ডিয়েগো ম্যারাডোনা বলে জানেন, সে-ই। ভেরি ঘনিষ্ঠ ফ্রেন্ড। তাই ‘ম্যারা’ বলেই ডাকি। ও আমাকে ডাকে সংক্ষেপে জাস্ট ‘কাউয়া’ বলে। যা-ই হোক, ম্যারার কণ্ঠে গভীর উদ্বেগ। বলে, ‘দোস্ত, ফেঁসে গেছি! কাপটা বুঝি গেল!’ আমি এক হাতে রিসিভারটা সামলে অন্য হাতে কাঁচি চালাতে চালাতে বললাম, ‘দ্যাখ ম্যারা, এই সাতসকালে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী-ফানি আমি করতে পারব না। আই অ্যাম ভেরি ব্যস্ত। দাড়ি ট্রিম করছি। প্লিজ, ফোন রেখে দে।’ আপনারা জানেন, ম্যারাডোনার কান্না বিশ্ববিখ্যাত। খুব সুন্দর করে কাঁদতে জানে ও। ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, ‘কাউয়া ডিয়ার, আমার বেস্ট শ্যুটার লিওনেল মেসির মাথায় হঠাৎ, মানে সামথিং টেরিবলি রং…প্র্যাকটিসে নেমে একটির জায়গায় তিনটি করে বল দেখছে চোখে, আর এলোপাতাড়ি ঠ্যাং চালাচ্ছে। ও গড, আমি শেষ!’ শুনে আমার হাত কেঁপে এক খাবলা বেশি দাড়ি কেটে গেল। তবু কোনোমতে বললাম, ‘তোদের আর্জেন্টিনায় ভালো ডাক্তার নেই?’ ম্যারা বিলাপ করে বলল, ‘সব ট্রাই করা হয়ে গেছে, দোস্ত। এখন তুই এসে বাঁচা। আমার দলের সব ছোকরার সাহস ভেঙে পড়েছে।’ আমি বললাম, ‘ছিঃ, এসব কী হচ্ছে ম্যারা! তোর কান্নাকাটি শুনে আমার দাড়ি কাটা উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে। এর ক্ষতিপূরণ তুই দিতে পারবি?’ ম্যারা বলে, ‘তোকে অনার করার জন্যই তো তোর দেখাদেখি আমিও একমুঠো দাড়ি রেখেছি। প্লিজ, তুই এসে আমার গেম প্ল্যানটা নতুন করে সাজিয়ে দিয়ে যা।’ এসব শুনে ওর জন্য আমার খুব মায়া হলো, যদিও আমি আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। ব্রাজিলের সাপোর্টার। হাউএভার, বললাম, ‘অক্কে, আমার বাসায় প্লেন পাঠিয়ে দে। ততক্ষণে আমি রেডি হয়ে নিই।’ ম্যারা বলল, ‘পাঠাচ্ছি। কিন্তু তোদের ঘিঞ্জি কলাবাগানে প্লেন ল্যান্ড করবে কোথায়?’ আমি একটু চটে গেলাম। বললাম, ‘কেন, কলাবাগান ক্লাবের মাঠে নামবে প্লেন। আমার বাসা থেকে পাঁচ টাকা রিকশা ভাড়া। তুই তো চিনিস, শালা। ইয়াং বয়সে একবার তোর টিম নিয়ে প্রীতি ম্যাচ খেলতে এসে কলাবাগান স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করে গেলি, মনে নেই? না, এক কাজ কর, তুইও আয়। পাইলটকে পথ দেখিয়ে আনবি। তা না হলে আবার কলাবাগান ছেড়ে কাঁঠালবাগান-টাগানে প্লেন নামিয়ে শেষে কোনো কেলেঙ্কারি ঘটাবে।’ খুশির চোটে ম্যারা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আমি ধমক দিয়ে বললাম, ‘অ্যাই, চোপ! ফোন রাখ!’
মহা ঝামেলা, ভাই। রিকশা নিয়ে আপনাদের ম্যারাডোনা একেবারে আমার বাসায় চলে এসেছে। চেম্বারে ক্লায়েন্টদের হাত-পা-মুখ দেখার কাজ আমার মাথায় উঠল। একেবারে পেটে লাথি। কলাবাগান মাঠে পৌঁছে দেখি কালো কালো ফুটবলের মতো কেবল মানুষের মাথা। প্লেন, ম্যারাডোনা অ্যান্ড মি—মিডিয়ার তৎপরতায় পাবলিক সব খবর পেয়ে গেছে। চারদিক মুখরিত শুধু স্লোগানে—‘ম্যারা-কাউয়া জিন্দাবাদ!’ ভিড় ঠেলে প্লেনে উঠলাম দুজনে। প্লেনটা ম্যারার মতোই ছোটখাটো, মজবুত আর ফাস্ট। পাইলটকে বললাম, ‘অই মিয়া, একটু টাইনা চালান। ঢাকায় আমার বহুত কাম। জলদি ফিইরা আইতে হইব।’
আর্জেন্টিনায় পৌঁছেই ওদের জাতীয় টিমকে তলব করে একটা প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলালাম। শোচনীয় অবস্থা। মেসি বারবার তার নিজ দলেরই গোলকিপারকে কড়া শটে পরাস্ত করছে। হুঁশ বিলকুল নষ্ট হয়ে গেছে ওর। কোচ ম্যারাডোনাকে চোখ পাকিয়ে বলছে, ‘গেট লস্ট!’ বোর্ডরুমে আমি বললাম, ‘হবে না। কাপ জিততে চাইলে বাংলাদেশ থেকে ক্রিকেটার সাকিব ও তামিমকে ‘হায়ার’ করতে হবে। ওরা মহা বিশ্বকাপ মানের ফুটবল অনুশীলন করে। রিটায়ার্ড একজন মুরব্বি ফুটবলারকেও নিতে হবে। আর নিতে হবে সদ্য এভারেস্টের চূড়া থেকে হেঁটে আসা পর্বতারোহী মুসা ইব্রাহীমকে। ২৯ হাজার ৩৫ ফুট ওপরে ছিল, মাইনাস ২৫ ডিগ্রি ঠান্ডায়। বিশ্বকাপের খেলা তো হচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র আড়াই হাজার মিটার উচ্চতায়। কাজেই মুসার দমের সঙ্গে কেউ পাল্লা দিতে পারবে না। ওর অক্সিজেন-বোতল, মাস্ক—কিছুই লাগবে না। তবে হ্যাঁ, পিঠে থান ইট-ভরা ব্যাকস্যাকটা লাগবে। ওটা ছাড়া মুসা দাঁড়িয়ে থাকতেই পারে না, দৌড়ানো তো বহু দূর।’ বোর্ড অফিশিয়ালদের বললাম, ‘আই অ্যাম এ গ্রেট জ্যোতিষী। কাজেই এই বিশ্বকাপে বিদেশি খেলোয়াড় ‘হায়ার’ করার বিশেষ অনুমোদন ফিফার মাথায় ফুঁ-ফাঁ দিয়ে আমিই আদায় করে নেব। ডোন্ট ওয়ারি।’ ম্যারা ট্যারা চোখে তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। ঠিক এই সময়ে আমার আড়াই সের ওজনের ১৯৮২ মডেলের মোবাইল ফোনখানা ফায়ার ব্রিগেডের ঘণ্টার মতো ঢং ঢং করে বেজে উঠল। ফোন তুলে বললাম, ‘হ্যালো, কে?’ ভাঙা গলায় একজন কেঁদে উঠে বলল, ‘মুই ব্রাজিলের দুঙ্গা, স্যার…!’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৪, ২০১০
Leave a Reply