বিশ্বকাপের খেলা দেখার জন্য বাবা ব্যাপক আয়োজন করেছেন। এত উঁচু যে এভারেস্ট, তারও একটা সীমা আছে। কিন্তু বাবার উৎসাহের কোনো সীমা নেই। এই উৎসাহ নিজের মধ্যে রাখলেও একটা কথা ছিল, উনি তা রাখছেন না। চেঁচামেচি করে সবার কানের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছেন। টিভিতে ম্যারাডোনাকে দেখালেই তিনি চিৎকার করে ওঠেন, ‘আরে, ম্যারাডোনা! অ্যাই, শুনছ, ম্যারাডোনাকে দেখাচ্ছে। আরে, ওই তো মেসি। দেখেছ, দেখেছ, বলটা কী করে কাটাল? শাবাশ ব্যাটা! সবগুলোকে দেখিয়ে দে, ফুটবল কী জিনিস!’ আমাদের বাসার আশপাশে কোনো কানের ডাক্তার নেই। থাকলে এই কয়েক দিনে চেম্বারে রোগীদের জায়গা দিতে পারত না। বাবার কারণে পাশের বাসার পিচ্চিও আমার সঙ্গে মশকারা করার সাহস পায়। আমাকে দেখলেই বলে, ‘ভাইয়া, আংকেলের টিভি দেখার টাইমটা বলবা, আমি তুলা কিনে রেখেছি, সময় হলেই কানে লাগাব।’
বাবা নিজে আর্জেন্টিনার বিরাট সমর্থক। তাঁর আচার-আচরণ দেখলে যে কেউ ভাববে, ম্যারাডোনা তাঁর ছোটবেলার বন্ধু। তাঁরা একই সঙ্গে বড় হয়েছেন, ফুটবল খেলেছেন। একসময় ম্যারাডোনা জীবিকার জন্য আর্জেন্টিনায় চলে যান, তারপর তো ইতিহাস। বাড়ির পেছনে ছাদ থেকে একেবারে নিচ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার বিশাল পতাকা। সেই পতাকার কারণে আমার ঘরের জানালা দিয়ে আলো-বাতাস দূরে থাক, মশা-মাছিও আসতে পারছে না। আলো-বাতাস না আসার চেয়ে বড় একটা সমস্যা আছে। একেবারে জীবন-মরণ সমস্যা। কিন্তু সেটা কাউকে বোঝাতেও পারছি না। বাবাকে গিয়ে বললাম,
‘বাবা, তোমার পতাকার কারণে আমার জানালা দিয়ে আলো-বাতাস আসছে না।’
‘তোর ঘরে লাইট-ফ্যান নেই? ওগুলো অন করে রাখ।’
‘বাসায় তো বিদ্যুৎই থাকে না। লাইট-ফ্যান দিয়ে কী হবে?’
‘বিদ্যুৎ না থাকলে আমার ঘরে চলে আসবি। ৪-৪-২ নাকি ৪-৩-৩—কোনটা বেস্ট ফরমেশন সেটা নিয়ে আমরা আলোচনা করব। গরমের মধ্যে একা একা বসে না থেকে মুক্ত আলোচনা করা ভালো না?’
বাবা আছেন তাঁর টিমের ফরমেশন নিয়ে। আর এই দিকে আমার অবস্থা খারাপ। এই পতাকাটা যে আমার কত ক্ষতি করছে, তা আমি কীভাবে বোঝাব? তার ওপর আবার মামা এসে হাজির। মামা ব্রাজিলের সাপোর্টার। বিশ্বকাপ এলে শুধু বাবার সঙ্গে ঝগড়া করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ঢাকায় আসেন। মামাকে গিয়ে বললাম, ‘মামা, এই ফালতু পতাকার জন্য ঘরে বাতাস আসে না। গরমে ঘুমাতে পারবে?’
‘ফালতু পতাকা মানে? তুই আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করিস না? পতাকা তুই লাগাসনি?’
‘আরে না, আমি তো ব্রাজিলের সাপোর্টার। গতবার রোনালদোকে দেখে মাথা ন্যাড়া করে ফেললাম, (কিসের ব্রাজিল, কিসের রোনালদো? মাথায় ফোঁড়া হয়েছিল, তাই ন্যাড়া হয়েছি) ভুলে গেছ? এবার তো রোনালদো নেই, তাই আর ন্যাড়া হলাম না।’
‘ও, তাই তো তাহলে এই ফকিরা পতাকা ঝুলিয়ে রেখেছিস কেন? ছিঁড়ে আপার কাছে দিয়ে দে, আপা ঘর মোছার জন্য ন্যাকড়া খুঁজছিল।’
‘বাবা তাহলে আমাকেই ন্যাকড়া বানিয়ে ফেলবে। তুমি পারলে এটা সরাও। না হলে দুজন মিলে গরমে কষ্ট পেতে হবে।’
‘অফকোর্স। আমি এমনিতেই গরম সহ্য করতে পারি না। এখনই একটা কিছু করতে হবে। নো লং প্রসেস। আমার থিওরি হচ্ছে, কবি নজরুলের মতো, লাথি মার, ভাঙরে তালা, যত সব বন্দীশালা, আগুন জ্বালা…টাইপ। চল, চল চল।’
আমি মামার সঙ্গে হাঁটা দিলাম। কেমন যেন একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব অনুভূত হচ্ছে। মামা হাসিমুখে বাবাকে বলল, ‘দুলাভাই, বরাবরের মতো আপনি কি এবারও আর্জেন্টিনার পক্ষে?’
‘অবশ্যই। আমি সব সময় আর্জেন্টিনার সমর্থক ছিলাম, আছি, থাকব।’
‘আপনার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে, এবারও আপনার দল কাপ জিততে পারবে না।’
‘তোমাকে কে বলেছে? নাকি তোমরা আগেই ফিফার সঙ্গে টাকা-পয়সা দিয়ে সব ঠিক করে রেখেছ?’
‘ছি, দুলাভাই! মনটাকে এত ছোট করবেন না। অবশ্য আপনাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা এমনই হয়। আপনি কানটা একটু পরিষ্কার করুন। শুনুন, প্রকৃতি কী বলে। প্রকৃতি বলে দিচ্ছে, এবার ব্রাজিল জিতবে। প্রমাণ চান?’
‘হেহ! প্রকৃতির আর খেয়ে কাজ নেই। বলো কী প্রমাণ?’
‘ওই শুনুন, কাক ডাকছে। কাক বলছে কা-কা, কা-কা! মানে হলো, সামান্য কাকও জানে, এবারের সেরা খেলোয়াড় হবে কাকা, তার মানে ব্রাজিলই জিতবে। বুঝেছেন?’
আমি দেখলাম বাবা কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই বললাম, ‘মামা, প্রকৃতি আর্জেন্টিনার কথাও বলছে। শুনে দেখেন, ছাগল ডাকে মেএএএ, মেএএএ! ছাগল আসলে মেসির কথা বলতে চাইছে।’
‘রাইট! খাঁটি কথা বলেছিস।’ বাবা লাফিয়ে উঠলেন।
মামা হেসে বললেন, ‘দুলাভাই, অত জোরে চেঁচাবেন না, হার্টে সমস্যা হতে পারে। শোনেন, ছাগলরাই আর্জেন্টিনার কথা বলে। ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আপনার কথা বলছি না, আমার ভাগ্নের কথা বলছি। আর সেই ছাগল মেসি নামটাও পুরো বলতে পারে না। মেএএ…বলে আটকে যায়। মানে সে দ্বিধাগ্রস্ত। আপনিও কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত।’
‘আমি?..আমার মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই।’
‘আছে। আপনি বাড়ির পেছনে আর্জেন্টিনার বিরাট এক পতাকা লাগিয়ে বসে আছেন। আর্জেন্টিনাই জিতবে, এই বিশ্বাস থাকলে আপনি বাড়ির পেছন দিকে পতাকা লাগাতেন না, অন্যদের মতো ছাদে লাগিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দিতেন, এবার আর্জেন্টিনাই জিতবে। বুঝেছেন?’
বাবা কিছু বললেন না। মনে হচ্ছে এখনই বিস্ফোরণ ঘটবে। মামাও মনে হয় বেশ ভয় পেয়েছে। হঠাৎ বাবা বললেন, ‘আবির, পতাকাটা খুলে ছাদে গিয়ে লাগা। এমনভাবে লাগাবি যাতে মঙ্গল গ্রহ থেকেও দেখা যায়। আমি জানি, আর্জেন্টিনাই জিতবে।’
আমি মহাখুশি হয়ে পতাকা খুলতে লাগলাম। মামা এসে বলল, ‘দেখলি, কীভাবে কাটিয়ে গোল দিলাম? একেবারে ব্রাজিলের মতো। শোন, বুদ্ধিমানরাই ব্রাজিল সাপোর্ট করে। তোকে তো গাধা ভাবতাম, এখন দেখছি তুইও বেশ বুদ্ধিমান। ঠিক বলেছি না?’
‘অবশ্যই। ব-তে ব্রাজিল, ব-তে বুদ্ধিমান (হেহ, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সব এক, বুদ্ধিমান না ছাই)।
মামা আমার পিঠ চাপড়ে বাইরে গেলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটা হাতে নিয়েই নাদিয়াকে ফোন দিলাম, ‘হ্যালো, জান, তাড়াতাড়ি জানালায় আসো। পতাকা সরিয়ে ফেলেছি।’
‘সত্যি? ইয়াহু! কীভাবে? ইস্, কী যে খুশি লাগছে! কত দিন পর আবার তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। অ্যাই, তুমি এখনো স্পেনের দলে আছ তো? অন্য দলে গেলে কিন্তু খবর আছে।’
‘আরে, আছি আছি। এবার স্পেনই জিতবে। তুমি আর আমি দুজনই স্পেনের সাপোর্টার তো। ভাবছি, জানালায় ছোট একটা স্পেনের পতাকা লাগাব।’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৪, ২০১০
Leave a Reply