ঢাকা শহরের বাসাবাড়িতে সবচেয়ে অপরিহার্য মানুষ কে?
নিঃসন্দেহে এর উত্তর হচ্ছে ‘বুয়া’ বা কাজের মানুষ। বেশ কিছুদিন আগ থেকেই দেশে বুয়া-সংকট চলছে। ছুঁড়ি-বুড়ি সবাই তৈরি পোশাকশিল্পে কাজ করতে চান। ‘বুয়া’ পেশায় সম্মান কম। পোশাকশিল্পে কাজ করলে অবিবাহিত মেয়েরা সহজে স্বামী জোগাড় করতে পারেন। এটা তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। ইদানীং এই সংকট আরও প্রকট হয়েছে ‘খাদ্দামা’ ভিসার কারণে। খাদ্দামা ভিসায় বাংলাদেশের মেয়েদের মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চাকরি দেওয়া হচ্ছে। পোশাকশিল্পের চাকরির চেয়ে এখন লোভনীয় হচ্ছে খাদ্দামা ভিসায় বিদেশে যাওয়া। যদিও এই শ্রেণীর নারীদের অনেকেই জানেন না, খাদ্দামা ভিসা মানেই হচ্ছে গৃহকর্মী বা বুয়ার চাকরির ভিসা। সেখানকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। অন্য কোনো লেখায় সেটি জানাব।
যা-ই হোক, নগরজীবনে বুয়া বড়ই গুরুত্বপূর্ণ। সকালের নাশতা থেকে রাতের খাবার পর্যন্ত তাঁরা আমাদের জীবনে অনেক সুবিধা করে দেন। কিন্তু ইদানীং বুয়ারা সুবিধার বদলে অসুবিধা করছেন বেশি। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই।
আমাদের বুয়ার সকাল আটটায় আসার কথা। এসে নাশতা তৈরি করবেন। ঘর পরিষ্কার, কাপড় ধোয়াসহ তাঁর কাজ তিন ঘণ্টা। কিন্তু নিয়ম করেই তিনি এখন আধ থেকে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত দেরি করে আসছেন।
দেরির কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারে জিজ্ঞাসা করেন! আমার কোনো দোষ নাই।’
আমার স্ত্রীর সঙ্গে এই নিয়ে নিত্য কলহ শুরু হয়।
বুয়ার বিলম্ব অনেকগুলো কাজের শিডিউল ভেঙে দেয়। ঠিক সময়ে নাশতা খাওয়া যায় না। বেরিয়ে পড়ি। অন্য সব কাজের শিডিউলও পিছিয়ে যায়। তার ওপর সকালে একটা হাউকাউ বাধে। কলহ-বিবাদ ভালো লাগে না।
অন্য অনেকেই বুয়াদের বিরুদ্ধে কঠোর অ্যাকশনে যান। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেন। আমরা সেটা করতে পারি না। কারণ, কিতাবে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে, কাজের মানুষের ত্রুটিগুলো প্রতিদিন ৭০ বার ক্ষমা করতে হবে।
অর্থাৎ প্রতিদিন ৭০ বার ক্ষমা করার পরই কাজের মানুষের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
যাঁরা কাজের মানুষকে শাস্তি দেন ও নির্যাতন করেন, তাঁদের জন্য বড় দুঃসংবাদ আছে।
আমাদের বুয়ার সমস্যাটা কী, সেটা জানতে আমি খুবই আগ্রহী। তাঁকে পুরো বিষয়টি বোঝালাম। সমস্যার কথা বললাম। তাঁর জন্য পুরো সিস্টেমে কী ব্যাঘাত ঘটছে, জানালাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, এবার সত্যি করে বলেন, এত দেরি করে আসেন কেন?
বুয়া একই উত্তর দিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারে জিজ্ঞাসা করেন! আমার দোষ নাই।’
আমাদের বুয়া শেখ হাসিনার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৪০ টাকা কেজির চাল ২০ টাকায় নেমে এসেছিল। তখন থেকে শেখ হাসিনার প্রতি তাঁর ভালোবাসা আরও অন্ধ হয়েছে। এ রকম একজন অন্ধ হাসিনাপ্রেমী কী কারণে অনায়াসে তাঁর বিলম্বে আসার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে দোষারোপ করছেন? তাঁর সব কাজ ও ক্ষতির জন্য প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করছেন?
আমি বললাম, ‘প্রধানমন্ত্রীকে পরে জিজ্ঞেস করা যাবে। যেহেতু আপনি দেরি করে আসছেন, আপনার কারণটা দয়া করে বলেন।’
বুয়া বললেন, ‘রাতে ঘুমাতে পারি না।’
‘রাতে ঘুমাতে পারেন না, ডাক্তার দেখান। ওষুধ খান।’
‘এই চিকিৎসা ডাক্তার-কবিরাজের না। তাঁরা কিছু করতে পারবেন না।’
‘যে করতে পারবেন, তাহলে তাঁর কাছে যান।’
‘সে জন্যেই তো বললাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারে জিজ্ঞাসা করেন। দোষ আমার না!’
আমি খুবই কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম, ‘রাতে আপনার ঘুম আসে না কেন, স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ?’
‘না।’
‘ছেলে দুষ্ট, চুরি-ছিনতাই এসব কাজ করে?’
‘না!’
‘অন্য কোনো দুশ্চিন্তা আছে?’
‘না!’
‘তাহলে রাতে ঘুম আসে না কেন?’
‘ঘুম আসব ক্যামনে? দিনে ঘণ্টায় ঘণ্টায় কারেন্ট যায়। সারা রাইত কারেন্ট থাকে না। সারা রাইত বড় লোকেরা জেনারেটর চালায়। জেনারেটরের আওয়াজ মানে কি আওয়াজ। মনে হয় যেন সারা রাইত কানের কাছে কেয়ামত নাইমা আসছে। কারেন্ট আসে ভোররাত্রে। তখন জেনারেটর বন্ধ হয়। তখন ইটটু ঘুমাই। উঠতে উঠতে দেরি হয়া যায়। কাজে আসতেও দেরি হয়। সরকার আমগো কারেন্ট দেয় না, এই দোষ তাইলে কার? সরকারের কি না বলেন?’
দেশে তীব্র বিদ্যুৎ-সংকট চলছে। এই সংকটের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বহুমুখী, সূক্ষ্ম ও ভয়াবহ। খুবই তুচ্ছ একটি ঘটনা এটি। যেখানে মিত্র আর মিত্র থাকছে না।
লোডশেডিংয়ের কারণে অনেক গৃহেই সকালটা এভাবে শুরু হয়। নিম্ন থেকে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত প্রায় সব মানুষ এর শিকার হন। এতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। কলহ-বিবাদ হচ্ছে। শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে।
কিন্তু বছরের পর বছর ধরে যাঁরা এ জন্য দায়ী, লক্ষ-কোটি মানুষকে যাঁরা কষ্ট দিচ্ছেন, অশান্তিতে ফেলছেন, তাঁরা কি শান্তিতে থাকতে পারবেন?
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৭, ২০১০
Leave a Reply