ছোট্ট ছেলেটা বিধাতার কাছে রোজ প্রার্থনা করে, ‘বিধাতা, আমাকে মাত্র ৫০০টা টাকা দাও। আমার আর কিছু চাই না।’ কিন্তু টাকা আর আসে না। তারপর বুদ্ধি করে একদিন সে বিধাতাকে একটা চিঠি লিখল। সেই চিঠি ডাকঘরে পড়ে রইল কিছুদিন। তারপর একদিন সহূদয় কোনো একজন পড়ে থাকা চিঠিটা খুলে পড়লেন এবং পাঠিয়ে দিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে। অতি আশ্চর্য ঘটনা হলো, চিঠিটা শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর হাতেই পড়ল। তিনিও মজা করে ২০০ টাকা পাঠিয়ে দিলেন, সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর একটা স্বাক্ষর। ২০০ টাকা পেয়ে খুশি হলো ছেলেটি। হাত তুলে মোনাজাত ধরে অভিযোগ করল, ‘বিধাতা, টাকাটা অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে কেন পাঠালে, তিনি তো ৩০০ টাকা ট্যাক্স কেটে রেখেছেন।’
সেই অর্থমন্ত্রী টাকা নিয়ে আসছেন। আর মাত্র দুই দিন পরেই বাজেট। তাও আবার ডিজিটাল বাজেট। এবার অর্থমন্ত্রী এক লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা নিয়ে আসছেন। অবশ্য যাঁরা পত্রপত্রিকা পড়েন, একটু খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা মনে করতে পারেন, এটা কোনো টাকা হলো? একা বিল গেটসের সম্পদই তো আছে ৫৩ বিলিয়ন ডলার। এর মানে হলো তিন লাখ ৬৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ পুরো বাংলাদেশের এক বছরের সব খরচ মিটিয়েও হাতে থাকে দ্বিগুণের বেশি টাকা।
থাক, আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খবর নিয়ে লাভ নেই। বরং নিজের দেশের মানুষের কথাই বলি। দেশের ১৬ কোটি মানুষকে তিনি বাজেট বরাদ্দের এই টাকা ভাগ করে দেবেন। আর অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে এই টাকা দেওয়া হয় বলেই হয়তো সেই ছোট্ট ছেলেটির মতো পুরো টাকা কেউ পাবেন না। সেই যে একটা ছড়া আছে—
বাজেট বাজেট মরার বাজেট
বাজেট আলুর দম
বড়র পাতে পড়ল বেশি
ছোটর পাতে কম।
এই ছড়া মেনে অর্থমন্ত্রী একটা কাজ করতে পারেন। কে বেশি পেল আর কে কম পেল সেই সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে। বাজেট যদি হয় এক লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকার, আর দেশের লোকসংখ্যা যদি হয় ১৬ কোটি, তাহলে একেকজনের ভাগে পড়ে আট হাজার ২৫০ টাকা। তবে পুরো বাজেট তো আর খালি উন্নয়নের জন্য না, এর বড় অংশই হচ্ছে অনুন্নয়ন বাজেট। উন্নয়ন বাজেটের অংশ মাত্র ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই হিসাবে একজন মানুষের পাওয়ার কথা দুই হাজার ৪০৬ টাকা।
প্রতিবছরই এখন দেখা যায়, ধনী আরও ধনী হচ্ছে, আর গরিব আরও গরিব। কারণ, বাজেটে যে অর্থ খরচ হয়, তাতে আসলেই গরিবের পাতে পড়ে কম। এ থেকে বাঁচতে হলে এভাবে মাথা গুনে গুনে অর্থ দিলে হয়তো গরিব মানুষ বাজেট থেকে কিছু পেতে পারত। কিন্তু নানা কারণে অর্থমন্ত্রী এ ধরনের মহামূল্যবান পরামর্শ গ্রহণ করবেন না। আর এর কারণ হিসেবে অন্য এক দেশের গল্প এখানে চালিয়ে দেওয়া যায়।
গল্পটা আফ্রিকার কোনো একটি দেশের হতে পারে। আবার আমাদের আশপাশের কোনো দেশও হতে পারে। এটা আসলে যেকোনো দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের গল্প বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়। একবার কোনো এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দেখা হয়ে গেল দুই দেশের দুই অর্থমন্ত্রীর। এক মন্ত্রী একটা ব্রিজের ছবি দেখিয়ে বললেন, এটার বাজেট ছিল ২০ কোটি টাকা। কিন্তু এটা ১২ কোটি টাকায় বানিয়ে আট কোটি টাকা নিজের পকেটে রেখে দিয়েছি। এরপর আমাদের আশপাশের কোনো এক দেশের সেই মন্ত্রী একটি নদীর ছবি দেখিয়ে বললেন, এই ব্রিজটি বানাতে খরচ হয়েছে ২০ কোটি টাকা। অন্য মন্ত্রী অবাক হয়ে বললেন, কোথায় ব্রিজ, কিছুই তো দেখছি না। এবার আমাদের মন্ত্রী মুচকি হেসে বললেন, ব্রিজ থেকে পুরো আয়ই আমার পকেটে।
গল্পটা হয়তো কাল্পনিক এবং বহু ব্যবহূত। কিন্তু কেউ যদি সত্যের কাছাকাছি ধরে নেন, তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না। এ তো গেল অর্থমন্ত্রীর গল্প। বাজেটের টাকা সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়ার পরামর্শে আঁতকে উঠবেন ধনীরাও। গল্পটা বলি। বাজেটে একবার রুগ্ণ শিল্প পুনর্বাসনে বেশ কিছু টাকা বরাদ্দ দিলেন অর্থমন্ত্রী। এর কিছুদিন পর ব্যাংককের সমুদ্রসৈকতে দেখা হয়ে গেল দুই ব্যবসায়ী বন্ধুর। এক বন্ধু জানতে চাইলেন, ‘কিরে কীভাবে হলো? কেমনে পারলি?’ আরেক বন্ধু তখন বলল, ‘আসলে মিলটা চালাতে পারছিলাম না, তারপর একদিন আগুন লেগে পুড়ে গেল। বিমা করা ছিল, আবার রুগ্ণ শিল্প পুনর্বাসন বরাদ্দ থেকেও কিছু পেলাম। তখন ভাবলাম, যাই, কিছুদিন ঘুরে আসি।’ এবার এই বন্ধু জানতে চাইল, ‘তোর কী অবস্থা?’। বন্ধুটা বলল, ‘খুব বন্যা হলো, আমার পুরো মিলই পানিতে ডুবে গেছিল।’ এবার এই বন্ধু চুপিচুপি জানতে চাইল, ‘বন্ধু, বন্যা লাগাও কেমনে?’
বাজেট আসে আর বাজেট যায়। প্রতিবারই মনে হয় এবার ভালো কিছু হবেই হবে। যাঁরা আশাবাদী, তাঁরা আশায় থাকেন। আর বাকিদের বলি, ‘গরিবদের আর যতই কষ্ট থাক না কেন, একটা বড় সুবিধা আছে। গরিব থাকার জন্য কোনো খরচা লাগে না।’ স্কটল্যান্ডের এই প্রবাদটা মানলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। বাজেট এল কি গেল, কী যায় আসে!
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৭, ২০১০
Leave a Reply