কদিন আগে মুসা ইব্রাহীম প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টে পা রেখে একেবারে হইচই ফেলে দিয়েছেন। তার পর থেকে সবার মুখে এই একই কথা। বাংলাদেশের সব জায়গায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে এভারেস্ট বিজয়। বিরোধী দল হরতাল ডেকেছে, বাজারে আম-কাঁঠাল-লিচু উঠে গেছে, সেগুলো পাকানোর জন্য ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে—এসব খবর কারও মাথাতেই নেই। পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় বড় করে এভারেস্ট-জয়ের খবর। প্রধানমন্ত্রীর ছবির জায়গায় মুসা ইব্রাহীমের হাস্যোজ্জ্বল ছবি। আসলে বাংলাদেশের সঙ্গে ‘জয়’ শব্দটা তো তেমন শোনা যায় না। সব সময় জয়ের আগে একটা ‘পরা’ থাকে। অনেক দিন পর মুসা ইব্রাহীম পুরো জাতিকে একটা ‘পরা’বিহীন জয় উপহার দিলেন। আহা, ভাবলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। আর জয় হলে যা হয় আর কি, সবাই একেবারে বিশেষজ্ঞের মতো আচরণ করা শুরু করে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ বিভিন্নভাবে এভারেস্ট জয়ের ব্যাপারটিকে বিশ্লেষণ করছেন। কেউ কেউ ভাবছেন, এত কষ্ট করে এভারেস্টে ওঠার কোনো দরকারই ছিল না। বাঙালির ধৈর্য যে কম তা এমনিতেই বোঝা যায়। বাচ্চা ছেলেও জানে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিমালয়ের বরফ গলতে শুরু করেছে। এভাবে গলতে গলতে এভারেস্ট একদম ছোট হয়ে এলে তিন লাফ দিয়েই এভারেস্ট জয় করা যেত। কিন্তু আফসোস! ধৈর্য নাই! তাই এখনই তড়তড় করে হিমালয়ের চূড়ায় উঠে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ভাবছেন, কেন শুধু শুধু এত কষ্ট করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভারেস্টে পা রাখতে হবে? হিমালয়ের পাশে একটা উঁচু দালান বানালেই তো ঝামেলা মিটে যায়। প্রথমে লিফটে করে সেই দালানের ছাদে উঠতে হবে, ছাদ থেকে এভারেস্ট পর্যন্ত একটা সেতু, সেটা দিয়ে হেঁটে গেলেই হেসেখেলে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছানো যাবে। আহ, কী সহজ সমাধান! অনেকে অবশ্য এর চেয়েও সহজ সমাধান খুঁজে পান। তাঁদের মতে, আরে ভাই, এত বড় দালানের চিন্তা ফালান। এর চেয়েও সহজ কায়দা আছে। একটা অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার থেকে সরাসরি এভারেস্টে নামলেই তো হয়। কাহিনি শেষ। কিন্তু কাহিনি আরও আছে। আমার এক বন্ধু তো বেশ ভাব নিয়ে বলা শুরু করেছে,
‘চাইলে আমিও এভারেস্টে পা রাখতে পারতাম। তোরা তো জানিস আমার অনেক সাহস। বাঘ-সিংহ, গরু-ছাগল কাউরে আমি ভয় পাই না।’
‘তাহলে বসে আছিস কেন? যা ওঠা শুরু কর।’
‘না মানে…আমার হাইট ফোবিয়া আছে তো।’
আরেক বন্ধু তো এভারেস্ট জয়কে কেন্দ্র করে নতুন ব্যবসার পরিকল্পনাই করে ফেলেছে। সে বলে, ‘দোস্ত, আমি পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়ি। পাবলিক কেমন তা আমার চেয়ে ভালো কে জানে? ভাবছি এভারেস্টে ওঠার জন্য একটা কোচিং সেন্টার খুলব। কয়েক দিন প্রচার করলেই দেখবি পিঁপড়ার মতো পাবলিক এসে ভর্তি হবে।’ বন্ধুর কথা শুনে তো আমি অবাক, এই ছেলে বলে কী? এদিকে এভারেস্ট বিজয়ের খবর শোনার পর থেকেই আমার এক ছোট ভাই এভারেস্টে ওঠার বায়না ধরেছে। আমরা সবাই মিলে তাকে বোঝাই, ‘দেখ, এভারেস্টে ওঠা অনেক কঠিন, তুই পারবি না।’ সে চোখ পাকিয়ে উত্তর দেয়, ‘পারব না মানে! আমি মানুষের ভিড় ঠেলে গুলিস্তান থেকে লোকাল বাসে উঠতে পারি, আর এভারেস্টে উঠতে পারব না? ওখানে তো ভিড় নাই, তাইলে কোনটা কঠিন?’ এই উত্তর শুনে আমিও একটু অফ হয়ে যাই। অবশ্য একদিক থেকে চিন্তা করলে দুটো ব্যাপার একই। আমি এভারেস্টেও উঠতে পারব না, আবার গুলিস্তান থেকে ভিড় ঠেলে লোকাল বাসেও উঠতে পারব ন। সমানে সমান। তবে এভারেস্টে উঠে মুসা ইব্রাহীম যে একটা দারুণ কাজ করেছেন, এ ব্যাপারে সবাই একমত। অনেকেই নিজ দেশের পতাকা ভুলে গিয়ে বাসার ছাদে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা লাগাচ্ছে। আর আমাদের মুসা ইব্রাহীম একেবারে এভারেস্টের চূড়ায় গিয়ে লাগিয়েছেন বাংলাদেশের পতাকা। মেসি না কাকা—কে সেরা এই তর্কের সঙ্গে চায়ের দোকানে এখন এভারেস্ট জয় নিয়ে আলোচনা চলে। চায়ের দোকানে যে ছেলেটা কাজ করে, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, খবর শুনেছিস? বাংলাদেশের একজন তো এভারেস্ট জয় করে ফেলেছে।
হ, হুনছি।
তুই এভারেস্টে উঠলে কী করতি?
ওইখানে তো অনেক ঠান্ডা, আগে দোকান থেইকা দুধ-চিনি বেশি দিয়া এক কাপ চা খাইতাম।
আরে গাধা! এভারেস্টের চূড়ায় চায়ের দোকান পাবি কোথায়?
কী যে কন, মামা! চায়ের দোকান ছাড়া কোন দ্যাশ আছে নি?
শোন, এভারেস্ট কোনো দেশ না। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ।
কী কন, মামা? এভারেস্ট একটা বড় দ্যাশ। আমাগো গ্রামের এক লোক ওইখানে থাকত। রাজধানীর নাম হিমালয়।
ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে কাপ থেকে চা ছিটকে পড়ে আমার প্যান্টে। পড়লে পড়ুক। আনন্দের সময় এত কিছু খেয়াল করলে চলে না।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ৩১, ২০১০
Leave a Reply