মুসা ইব্রাহীমকে আমি বেশ আগে থেকেই এক চোখে দেখতে পারি না। সমপ্রতি তাঁর এভারেস্ট বিজয়ের কারণে দুই চোখেই দেখা ছেড়ে দিয়েছি।
তবে তাঁর হূদয়ে পর্বতের প্রতি একটা গভীর টান আছে বলেই হয়তো তিনি আমাকে বেশ ভালোই দেখতে পেতেন। বছর পাঁচেক আগের কথা, তিনি আর আমি দুজনই তখন দৈনিক যায়যায়দিন-এ কাজ করি। প্রায়ই অফিস শেষে তিনি তাঁর বাইকে করে আমাকে বাসায় নামিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিতেন। আমি সাধারণত বাইকে চড়তে ভয় পাই, তার ওপর সেটা চালাবে মুসা ভাই। মূলত দ্বিতীয় কারণেই আমি কখনো রাজি হই না।
কাজ শেষ হতে একবার বেশ রাত হয়ে গেল। তেজগাঁও থেকে মিরপুরের সিএনজিচালিত অটোরিকশা পাওয়ার জন্য রাস্তায় নামা তখন এভারেস্ট না হলেও অন্নপূর্ণা পর্বতশৃঙ্গ বিজয়ের কাছাকাছি একটা বিষয়। কাজেই সেদিন রাজি হয়ে গেলাম। গভীর রাত, অন্ধকার গলিঘুপচি, ভাঙা রাস্তা, সাপের মতো আঁকাবাঁকা, অথচ হাওয়ার বেগে মুসা ভাই বাইক ছোটাচ্ছেন। পাঁচ মিনিট পর চলন্ত অবস্থাতেই পেছনে ঘুরে জানতে চাইলেন ভয় পাচ্ছি কি না। তখন ভয় না পেয়ে থাকলেও ওনাকে পেছনে তাকিয়ে সামনে ছুটতে দেখে আমি কোনোমতে ‘কুঁই’ ধরনের একটা আওয়াজ করলাম। এই ‘কুঁই’-এর অর্থ তিনটি হতে পারত। এক. জি, আমি ভয় পাচ্ছি। দুই, জি না, আতঙ্কিত হচ্ছি না। তিন. ভয় তো পাচ্ছিই, আপনি এখনই সামনে না তাকালে সর্বোচ্চ ত্রিশ সেকেন্ডের ভেতর অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারি। তবে তিনি সম্ভবত নিজের মতো করে এর চতুর্থ একটি অর্থ করে নিলেন, ‘জলদি চলেন, সময় নাই।’ এতক্ষণ বাইক হাওয়ার বেগে ছুটছিল, কুঁইয়ের পরে সেটা পেল ডাবল হাওয়ার বেগ। সাত রাস্তা ছেড়ে এগিয়ে এসে এফডিসির দিকে মোড় ঘুরতেই দেখি রেলক্রসিং পড়ি পড়ি করছে। বাইকের গতি আরও বাড়ল। আমি নিশ্চিত হলাম, পরবর্তী দৃশ্য হবে—বাইক একাই চলে গেছে সার্ক ফোয়ারার কাছাকাছি, রেলক্রসিংয়ের রেলিংয়ে আমরা দুজন লটকে আছি আর ট্রেনের যাত্রীরা বগির ভেতর থেকে গলা বের করে আমাদের দিকে তাকিয়ে খিকখিক করে হাসছে। তবে না, নামতে থাকা রেলক্রসিংয়ের দণ্ডটি মাথার আনুমানিক দুই সুতা ওপরে থাকা অবস্থায় আমরা পার হয়ে গেলাম। আমি বজ্রাহত হয়ে বাইকের পেছনটা আঁকড়ে ধরে বসে আছি। এফডিসি, সোনারগাঁও, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, বিজয় সরণি পার হয়ে রোকেয়া সরণিতে ওঠার পর হঠাৎ মুসা ভাই জানতে চাইলেন, ‘অনিক, এখনো আছেন তো?’ আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উল্টো প্রশ্ন করালাম, ‘মুসা ভাই, এতক্ষণে?’ সেদিন থেকে আমি মুসা ইব্রাহীমকে এক চোখে দেখা ছেড়ে দিই।
ইতিমধ্যে এটিএন নিউজে মুসা ইব্রাহীমের মায়ের একটা ইন্টারভিউ দেখলাম। তিনি জানালেন, মুসা নাকি ছোটবেলা থেকেই বেশ ভীতু প্রকৃতির ছিলেন। আমার ব্যক্তিগতভাবে তাঁর বাইকে একাধিকবার চড়ার ‘দুর্ভাগ্য’ হয়েছে, কাজেই আমি খালাম্মার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করলাম এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে ওনার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করছি।
যা-ই হোক, মুসা ইব্রাহীমকে দুই চোখে দেখা ছেড়ে দিই এই তো গত ২৩ মে সকাল আটটার দিকে, যখন তাঁর এভারেস্ট জয়ের কথা কানে এল। সেই দিন আমি ঘটনার পাকচক্রে নেপালের কাঠমান্ডুতে। ব্যাপারটা এমন—এভারেস্টশৃঙ্গে মুসা ইব্রাহীম, বঙ্গোপসাগরের তীরে দেশের সব সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম; আর বেচারা আমি দুই টান টান উত্তেজনার মাঝামাঝি কাঠমান্ডুর ভয়ংকর উপত্যকায়। সারা দিন কেটে গেল খবর নিশ্চিত করার জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে (তখন অবশ্য একবার মনে হয়েছে, সঙ্গে মুসাচালিত বাইকটি থাকলে ভালোই হতো)। এর পাশাপাশি আরও বলতে হয়, মুসা ইব্রাহীমের বন্ধু নির্বাচনেও যথেষ্ট গলদ রয়েছে। আমার এই চরম দৌড়ঝাঁপের মধ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে টেলিফোন করে জ্বালাতন করেছে যে বন্ধুরা, তাদের অধিকাংশই সাংবাদিক। সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাদের যন্ত্রণা তাও মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু আরেক বন্ধু লেখক ফখরুল আবেদীনের নিতান্ত অকারণেই অন্তত চার হাজারবার ফোন করে আকুল-ব্যাকুল কণ্ঠে ‘অই মিয়া, লেটেস্ট খবর কী?’ জানতে চাওয়ার অর্থ কী? এই প্রশ্নের জবাব কি রাষ্ট্রযন্ত্র আমাকে দেবে?
কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, মুসা ইব্রাহীম এভারেস্ট জয় করেছেন তাতে কী হয়েছে? এর চেয়ে অনেক বড় বড় বিজয় আমরা প্রতিনিয়ত করছি। মুসা ভাই নিজেও করেছেন। এভারেস্টে বিদ্যুৎ যায় না, পানির (বরফ আকারে) অভাব নেই, হরতাল নেই, সিএনজিওয়ালারা দশ টাকা বাড়িয়ে চায় না…নানান সুযোগ-সুবিধা। আবার দেখুন, তিনি এভারেস্ট জয় করলেন মাত্র একবার, অথচ এই যে প্রতি সপ্তাহে, মাসে প্রায় চারবার করে রস+আলো বের হচ্ছে, তার মূল্যায়ন কোথায়? শুধু তা-ই নয়, দেশের নানান পথেসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায়, যেমন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার যে সুউচ্চ স্পিড ব্রেকারগুলো আছে, গাড়ি বা রিকশা চালিয়ে সেগুলোর কোনোটাই পার হওয়া এভারেস্ট জয় করার চেয়ে কম কিছু নয়। জাতির ক্ষয়িষ্ণু বিবেকের কাছে এটা আমার প্রাইভেট প্রশ্ন, আমাদের এই সব চালক ভাইদেরই মূল্যায়নই কোথায়?
কত মানুষ ভুটান, নেপাল, তিব্বত, ব্যাংকক যায়; বান্ধবীর হাত ধরে ঘুরে বেড়ায়। পুরো ঘুরে বা মাঝপথ থেকে আবার দেশে ফিরে আসে। মুসা সেটা না করে কেন এভারেস্ট জয় করতে গেলেন? এ জন্যই তো এত এত প্রশ্ন আজ আমাদের সামনে। যে প্রশ্নগুলো আমরা ভুলে গিয়েছিলাম, সেগুলোই আবার আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন মুসা। এই অপরাধের জন্য আমি মুসার আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার দাবি করছি। তবে এই বিচারের প্রক্রিয়াটি কোনো উন্নত ও গরম দেশে হলে ভালো হয়। বেচারা দীর্ঘদিন ঠান্ডার মধ্যে ছিলেন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ৩১, ২০১০
Leave a Reply